মহামারি করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল। ২০২২ সালেও ছিল বিশেষ সুবিধা। চলতি বছর সব সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংক। যে কারণে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে খেলাপি ঋণ। অনেক ব্যাংক এসব ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে সরকারি-বেসরকারি খাতের ৮ ব্যাংক; যাদের ঘাটতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে সরকারি তিন ব্যাংক, বেসরকারি চার এবং একটি বিশেষায়িত ব্যাংক ২০ হাজার ১৫৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক, অগ্রণী, রূপালী; বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এবং বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)।
২০২২ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ১৯ হাজার ৪৮ কোটি। অর্থাৎ তিন মাসে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ১ হাজার ১১১ কোটি। এতে ব্যাংকের আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক ব্যবসা করে আমানতকারীদের জমানো অর্থ দিয়ে। ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, ওই ঋণের গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ব্যাংকের ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে (খেলাপি) পরিণত হলে পরে যেন আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, এজন্যই প্রভিশন রাখার বিধান রয়েছে। এখন কোনো ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। এক সময় কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি থাকলে শুধু সতর্ক ও ঘাটতি মেটাতে দিকনির্দেশনা দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো ব্যাংকে টানা দু’বছর ঘাটতি থাকলে তার বড় অঙ্কের জরিমানাসহ লাইসেন্স বাতিলের কথা বলা আছে। এসব কারণে বিভিন্ন উপায়ে প্রভিশন ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করে ব্যাংকগুলো।
নীতি অনুযায়ী, বর্তমানে অশ্রেণিকৃত ঋণের ধরন অনুযায়ী দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো তাদের নিয়মিত বা অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফার ০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত, ‘সাব স্ট্যান্ডার্ড’ বা নিম্নমানের শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং ‘ডাউটফুল’ সন্দেহজনক শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ, আর ‘মন্দ’ মানে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয় শতভাগ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে বেসিক ব্যাংকের। মার্চ শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। এরপরই ৪ হাজার ১১ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের। তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে রূপালী ব্যাংক, তাদের ঘাটতি ৩ হাজার ৮০ কোটি টাকা।
চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৫৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার ৯৪৩ কোটি বা প্রায় ২২ শতাংশ এবং রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ।
প্রভিশন ঘাটতির তালিকায় বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। বিভিন্ন কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকটি এখন আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকটির মন্দ বা খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে সাত হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আলোচিত সময়ে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ মেহমুদ হোসেনের সঙ্গে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রভিশন ঘাটতিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা ব্যাংকের ৪৯৭ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৩৬০ কোটি টাকা ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৬০ কোটি টাকা। এছাড়া বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) প্রভিশন ঘাটতি ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়ায় প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। এখন যেসব ব্যাংক ঘাটতিতে পড়েছে তাদের খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। কারণ যদি কোনো কারণে এসব ব্যাংক সমস্যায় পড়ে তাহলে প্রভিশন না থাকলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পরবে না।
খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, যারা খেলাপি হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ঋণ আদায়ে জরিমানার পাশাপাশি যেসব জমি সম্পদ ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে তা ব্যাংকের অনুকূলে নিয়ে নিতে হবে। খেলাপিরা যেন বিশেষ ছাড় ও রাজনৈতিক মহলে যেন সুবিধা না নিতে পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। অনিয়মের শাস্তি নিশ্চিত করলেই ঋণ আদায় বাড়বে খেলাপি কমে যাবে।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয় বলে ধরা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। তিন মাস আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ হাজার কোটি টাকা। এর আগে ২০২২ সালের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা সেই সময়ের মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সেই হিসাবে গত বছরের মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় এ বছরের একই প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। আর দুই বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৭ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ খেলাপি হয়ে আছে।
বেসরকারি ব্যাংকে আলোচিত সময়ে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৫ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে আছে ৬৫ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ ৬২ হাজার ২৭ কোটি টাকা; যার মধ্যে ৩ হাজার ৪১ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ খেলাপি এবং বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলোর ৩৬ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ বা ৪ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে ৯২ হাজার ৬২০ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার কথা ছিল। তবে সংরক্ষণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। এর মানে প্রয়োজনের তুলনায় ১৬ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা সামগ্রিক ঘাটতি হয়েছে। তিন মাস আগে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার কোটি টাকা।
কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেওয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম।