তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বহিষ্কার দাবি করে চরমোনাই পীর মুফতি রেজাউল করিম বলেছেন, ‘মানুষের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত করে রাজনীতিক নেতা ও মন্ত্রীদের কথা বলার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।’ শনিবার দুপুরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি জানান।
লিখিত বক্তব্যে চরমোনাই পীর বলেন, ‘ক্ষমতাসীন রাজনীতিক দলের নেতা ও মন্ত্রীরা প্রায়ই ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। সম্প্রতি একজন প্রতিমন্ত্রীর বালখিল্যতা জাতি দেখেছে। অপরিপক্ব সেই প্রতিমন্ত্রী যেভাবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে মন্তব্য করেছেন তাতে জনরোষ আরও বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এরশাদের আমলে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হয়েছিল। এখনও সেটা বহাল আছে। সেটা বহাল থাকার পরও একজন প্রতিমন্ত্রী রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এটা সংবিধান পরিপন্থি।’
মন্দিরে হামলার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা দাবি করে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের সাধারণ চরিত্র নয়। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ও মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা এ ধরনের ঘটনাকে সমর্থন করে না।’ দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে অদক্ষ মন্তব্য করে চরমোনাই পীর বলেন, ‘এ ঘটনার সূত্রপাত থেকে পরবর্তী প্রতিটি ঘটনায় প্রশাসনের ব্যর্থতার ছাপ স্পষ্ট। ৫০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে এ ধরনের ব্যর্থতা কল্পনাতীত। আমরা মনে করি, জনপ্রশাসনে অতিমাত্রায় রাজনীতির কারণে সামগ্রিকভাবে দেশের প্রশাসন ব্যবস্থায় এক ধরনের অদক্ষতা তৈরি হয়েছে। যার খেসারত এসব ঘটনা।’
‘কুমিল্লার ঘটনা সাম্প্রদায়িক নয়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, কুমিল্লার ঘটনার পর বাংলাদেশের একশ্রেণির মিডিয়া, রাজনীতিক সংগঠন ও সুশীল সমাজ যেভাবে ঘটনাকে শুধু সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে ব্যাখ্যা করেছে তা হতাশাজনক।’সংবাদ সম্মেলনে কুমিল্লার ঘটনার তদন্ত দাবি করে বলা হয়, ‘এ ধরনের ঘটনার কখনই সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা হয় না। প্রায় সব ক্ষেত্রেই আশ্বাস দেওয়া হয় কিন্তু বিচার হয় না। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতিই অপশক্তিগুলোকে বারবার ধর্ম অবমাননার মাধ্যমে উত্তেজনা তৈরির কৌশল ব্যবহারে উৎসাহিত করে।’
দাবিতে করণীয় হিসেবে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। ফলে যে ধর্মের অবমাননা করা হয় সেই ধর্মের অনুসারীরা এক ধরনের অসহায় বোধ করেন। এ থেকেই তারা তৎক্ষণাৎ বিক্ষোভ দেখানো ও ক্ষেত্র-বিশেষে সহিংস বিক্ষোভ প্রদর্শনে উৎসাহিত হন।’‘দেশে একদলীয় শাসন চলছে’ মন্তব্য করে চরমোনাই পীর বলেন, ‘দেশে যখন একদলীয় শাসন চলে, সরকার যখন বিরোধী রাজনীতিক দলগুলোকে কোণঠাসা করে রাখে তখন অনিয়ন্ত্রিত বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কুমিল্লা ও দেশব্যাপী তারই বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। সরকার যখন স্বৈরাচারী ও শক্তিনির্ভর হয় তখন যে কোনো সামাজিক সমস্যার সমাধানে জনতার মধ্যেও শক্তিনির্ভর পন্থার প্রবণতা দেখা দেয়। সাম্প্রতিক ঘটনায়ও তাই দেখা গেছে।’
সংবাদ সম্মেলনে কুমিল্লার ঘটনা-পরবর্তী ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিটি করার দাবি জানিয়ে বলা হয়, ‘কুমিল্লায় কোরআন অবমাননা, বিভিন্ন স্থানে মন্দির-প্রতিমা ভাঙচুর, রংপুরে আগুন দেওয়া ও চাঁদপুরে বিক্ষোভে গুলি করে হত্যার বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খানু তদন্ত করতে হবে এবং সেই কমিটির তদন্ত রিপোর্ট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জনসম্মুখে প্রকাশ করে অপরাধীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’
দাবিতে চরমোনাই পীর আরও বলেন, ‘ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইন করতে হবে এবং সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে কোনো ধরনের ধর্ম অবমাননার ঘটনা ঘটলে জনতা আর সহিংস হয়ে উঠবে না। দেশের স্বাভাবিক রাজনীতিক পরিবেশ ফেরাতে বিরোধী দলগুলোর ওপরে দমন-পীড়ন বন্ধ করতে হবে। আটক রাজনীতিক বন্দিদের মুক্তি দিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শাসন ব্যবস্থায় জনতার মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে বহুদলীয় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর রাজনীতিক ব্যবহার বন্ধ করতে নিয়োগে রাজনীতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে বাহিনীগুলোকে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। গণবিক্ষোভে গুলি করার মতো চরমপন্থা অবলম্বন করার প্রবণতা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও সংখ্যালঘুদের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি সরকারিভাবে নির্মাণ করে দিতে হবে। যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারসহ ক্ষতিগ্রস্ত সব ব্যক্তি ও পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’
চরমোনাই পীর আরও বলেন, ‘দেশের একশ্রেণির মিডিয়া, রাজনীতিক সংগঠন ও তথাকথিত সুশীল সমাজ এই ধরনের ঘটনায় যেভাবে ধর্মকে কেন্দ্র করে একপাক্ষিক বক্তব্য দেন তা বন্ধ করতে হবে। বাঙালি জাতির ইতিহাস ও মনস্তত্ত্ববিরোধী তাদের এই ধরণের বক্তব্যের পেছনে কোনো দুরভিসন্ধি আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। প্রতিবেশী দেশকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা দিতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে ধর্ম অবমাননাকে কেন্দ্র দেশের বিভিন্ন জায়গায় সনাতন সম্প্রদায়ের মন্দির ও ঘরবাড়িতে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে তার তীব্র নিন্দা করে তার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের দ্রুত বিচার দাবি করেন চরমোনাই পীর। সংবাদ সম্মেলনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমাদ, সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী, আলহাজ খন্দকার গোলাম মাওলা, অধ্যাপক মাহবুবুর রহমানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।