বাজারে কৃত্রিম এ সঙ্কটের পেছনে কলকাটি নাড়ছে ‘সিন্ডিকেট চক্র’। যে চক্রে আছে খুচরা থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ীরা। যে যেভাবে পারছে ভোক্তার পকেট কাটছে। এ চক্রের প্রধান হাতিয়ার— একে অন্যকে দোষারোপ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বছরে যে পরিমাণ পেঁয়াজ দরকার এবার তার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে। ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ মজুত রেখে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়াচ্ছেন। সিন্ডিকেটের এই চক্রে রয়েছেন খুচরা থেকে বড় ব্যবসায়ী। তারা দাম বৃদ্ধির বিষয়ে একে অপরকে দোষারোপ করেন। এর মধ্যেই সবাই অবৈধ মুনাফা করে নিচ্ছেন।
মঙ্গলবার রাজধজানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে। একটু নিম্নমানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা কেজি দরে। যা তিন দিন আগেও বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় । অর্থাৎ ৩ দিনের ব্যবধানে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজিতে। যা তিন আগেও ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি।
সরকারের বাজার মনিটরিং প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেও একই চিত্র উঠে এসেছে। টিসিবির তথ্য মতে, ২১ আগস্ট রাজধানীতের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি। আমদানি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে। যা এক মাস আগেও ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা ও ৩০ থেকে ৫০ টাকা কেজি। তিন বছর আগের অর্থাৎ ২০২০ সালে এই দিনে দেশি পেঁয়াজের মূল্য ছিল ৩৪ থেকে ৪৫ টাকা কেজি। আর আমদানি পেঁয়াজের কেজি ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে কেজিতে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫৫ টাকা। আর আমদানি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৩৫ টাকা।
রাজধানীর মালিবাগ কাঁচাবাজারে বাজার করতে আসা রঞ্জন হাওলাদার বলেন, ‘গত শুক্রবার পেঁয়াজ কিনলাম ৭০ টাকা কেজিতে। আজকে বলছে ১০০ টাকা কেজি। দুদিনের ব্যবধানে দেশে এমন কী ঘটল, যে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে যাবে। আবারও ব্যবসাযীরা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছে। আমাদের পকেট খালি করছে।’
একই বাজারের ব্যবসায়ী সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘আড়তে শুনেছি, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ। সে কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। তারা দাম বাড়াচ্ছে। আমরা বেশি দামে কিনছি, তাই বেশি দামে বিক্রি করছি।’
তিনি বলেন, ‘শনিবারও ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ৫০ টাকা কেজি। মাঝারি পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি। আর ভালো মানের আমদানি পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ৬০ টাকা কেজি। আজকে আমদানি পেঁয়াজ বিক্রি করছি ৭০ টাকা কেজি। আমাদের কেনাই পড়েছে ৬৪ টাকা কেজি।’
রাজধানীর শ্যামবাজারের পাইকারি (আড়ৎদার) ব্যবসায়ী আব্দুল মাজেদ বলেন, ‘ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এ কারণে পেঁয়াজ আমদানি ক্ষেত্রে এখন ৪০ শতাংশ টাকা বেশি দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে। এতে পাইকারি পর্যায়ে কেজিতে ১০ টাকা দাম বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘শ্যামবাজারে আজকে আমদানি পেঁয়াজ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। আর দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭২ টাকা কেজি।’
রপ্তানির ওপর শুল্ক বাড়ানোর পেঁয়াজ তো এখনো ঢাকা আসার কথা নয়, তারপরও দাম বাড়ল কীভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন ভারত থেকে আসতে সময় লাগে না। যে দিন কেনা হয় সে দিনই বাংলাদেশে চলে আসে। তবে এই সুযোগে কিছু ব্যবসায়ী পেঁয়াজ বেশি দামে বিক্রি করছেন।’
গত শনিবার (১৯ আগস্ট) পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে ভারত। দেশটির কর্তৃপক্ষ বলছে, শুল্ক আরোপের এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর করা হবে। ভারতের পেঁয়াজের ওপর আরোপিত নতুন এই শুল্ক চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহাল থাকবে। শনিবার দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে এসব তথ্য জানানো হয়।
সেই হিসাবে আমদানি পেঁয়াজের দাম বাড়াটা যৌক্তিক কিন্তু দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়ছে কেন এমন প্রশ্নের জবাবে আড়ৎদার আব্দুল মাজেদ বলেন, ‘চাহিদার তুলনা সরবরাহ কম থাকলে এমনিতে পণ্যের দাম বাড়ে। তাই ব্যবসায়ীরাও বাড়িয়েছেন।’
কারওয়ান বাজারে ব্যবসায়ী গৌতম বাবু বলেন, ‘ভারতীয় পেঁয়াজ আগে ছিল ৪০ টাকা কেজি। এখন বিক্রি করছি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি। দেশি পাবনার পেঁয়াজ ও ফরিদপুরের পেঁয়াজ আগে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা ছিল। এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি। একইভাবে পাবনার দেশি পেঁয়াজ ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি। এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে বেড়ে ৯০ টাকা কেজিতে।’
চট্টগ্রামের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী ও চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘জলাবদ্ধতার কারণে বিভিন্ন গোডাউনে পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। একই কারণে বাজারে কয়েকদিন গাড়ি প্রবেশ করতে পারেনি। এতে বাজারে সরবরাহ কমে গেছে। তাই দাম বাড়তির দিকে।’
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘আমদানি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা বাড়তে পারে। কিন্তু দেশি পেঁয়াজ বাড়ার কোনো কারণ দেখছি না। অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে মুনাফা তুলে নিচ্ছে।’
প্রায় একই কথা বলেন ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, ‘শুল্ক আরোপের ঘোষণা হয়েছে শনিবার, সেই পেঁয়াজ দেশের বাজারে আসতে তো দু-তিনদিন সময় লাগে। কিন্তু সেদিন থেকে আমাদের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এতা কী করে হয়?’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা লোভ, তাদের স্বভাব এমনই। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি দামের পণ্য দেশে আসার আগেই দাম বাড়িয়ে দেন তারা। আবার কোনো সময় দাম কমলেও পণ্য এখনো আসেনি বলে দাম কমাতে চান না।’
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য মতে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। এ বছর দেশীয় উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদন আরও বেশি হয়েছে। তবু পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। এর আগের বছর ২০২১-২২ অর্থ বছরের ২ দশমিক ৫৯ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়। এতে উৎপাদন হয় ৩৬ দশমিক ৪১ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ।
দেশে পেঁয়াজের বিপুল মজুত আছে, কয়েক দিন পর দাম কমে আসবে—কৃষিমন্ত্রী
ভারতীয় পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০% শুল্ক আরোপ ও দেশের বাজারে হঠাৎ দাম বৃদ্ধির বিষয়ে গত রোববার (২০ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর ফার্মগেটে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের (সিডিবি) মিলনায়তনে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত ১৩ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়েছি, দেশে এসেছে মাত্র তিন লাখ টন। এর অর্থ হলো দেশেও পেঁয়াজ আছে। মাঠ পর্যায়েও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের কৃষকদের কাছে এখনো বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজের মজুত আছে। কাজেই, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০% শুল্ক আরোপ করলেও দেশে পেঁয়াজের দামে তেমন প্রভাব পড়বে না। শুল্ক আরোপের ঘোষণায় এখন দাম কিছুটা বাড়লেও কয়েক দিন পর কমে আসবে। তুরস্ক, মিশর ও চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানির চেষ্টা করা হবে।’
পেঁয়াজ রপ্তানিতে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পিযুস গয়ালের সঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক কথা বলেছেন বলেও তিনি জানিয়েছেন।