ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শর্তই পূরণ হয়নি। ফলে নির্ধারিত সময়ে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়া নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যা বাংলাদেশকে জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি ফেলতে পারে।
অবশ্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক আশাবাদী। তাদের মতে— পূরণ করতে না পারা শর্তগুলো পর্যালোচনার পর আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে সমস্যা হবে না।
পূরণ করতে না পারা শর্তগুলো হলো, সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ অন্তত ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের নেট রিজার্ভ থাকা এবং অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে রাজস্ব আদায় অন্তত ৬১ হাজার কোটি টাকা হওয়া।
দ্বিতীয় কিস্তি পেতে সমস্যা হবে?
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, রিজার্ভ ও রাজস্ব আহরণসহ অনেকগুলো বিষয়ে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলেও ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
যদিও মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট মোকাবেলা, খেলাপি ঋণ এবং জ্বালানি তেলের দাম ছাড়াও চলতি সফরে আরও যেসব বিষয়ে আইএমএফের উদ্বেগ আছে। বিশেষ করে সংস্থাটির সাথে জ্বালানি তেলের বিশেষ করে বিপিসি যেসব জ্বালানি বিক্রি করে সেগুলোর দাম নির্ধারণের জন্য একটি ফর্মুলা ঘোষণা করার কথা থাকলেও বাংলাদেশ এখনো তা করতে পারেনি। এ নিয়ে আইএমএফ ইতোমধ্যেই তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আবার কিছু ক্ষেত্রে নেওয়া পদক্ষেপ সঠিক ছিল না। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক হয়নি। খেলাপি ঋণ নিয়েও উদ্বেগ আছে আইএমএফের। এখন উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা শেষ যেসব বিষয়ে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি আর যেসব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার পদক্ষেপ নিতে পারেনি সেগুলো নিয়ে নতুন পরামর্শ আসতে পারে আইএমএফের দিক থেকে। তারা হয়তো বলবে তোমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারোনি। তোমাদের পলিসি কাজ করেনি। সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেই। তারা অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করবে। তাগিদ দেবে। কিন্তু মনে হয় না দ্বিতীয় কিস্তি আটকাবে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলছেন, সরকারের পদক্ষেপ ও নীতিগুলো কতটা কার্যকর হচ্ছে বা সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে কি-না বা কখন নিতে যাচ্ছে- এসব ঋণ পর্যালোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে আইএমএফের কাছে। এসব বিষয়ে সংস্থাটি পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট না হতে পারলে এখন কিস্তি প্রাপ্তি আটকে যাওয়াটাও অসম্ভব বিষয় নয়। যদিও বিষয়টি নির্ভর করছে বাংলাদেশ কোন বিষয়ে কী ব্যাখ্যা দেয় এবং তাদের কর্মপরিকল্পনা কী তার ওপর।
গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, রিজার্ভের ক্ষেত্রে আইএমএফ দেখতে পারে যে রিজার্ভে লক্ষ্য অর্জন না হলেও সেটি সামনে আরও কমার ইঙ্গিত আছে কি না।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাস্তবতা হলো এখন রিজার্ভ স্থিতিশীলও রাখা যাচ্ছে না। বরং পতনের দিকেই আছে। তাই এটি লোন রিভিউর ক্ষেত্রে বড় বিবেচনায় থাকবে বলে মনে হয়। সেক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে আইএমএফ এমন কিছু পদক্ষেপ চাইতে পারে যাতে রিজার্ভের পতন ঠেকানোর নিশ্চয়তা পাওয়া যায়।
টেনশন তৈরি হবার আশঙ্কা
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন— যদি কোনো কারণে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেতে বিলম্ব হয় তাহলে জরুরি আমদানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরও অনেক কাটছাঁট করতে হতে পারে। অর্থনীতিতে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে টেনশন তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও আছে।
অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিশেষ করে জ্বালানি খাতে এখন বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ১৫-২০ মিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করতে হয়। ঋণ পেতে বিলম্ব এলে জ্বালানির এই খরচ কমাতে গিয়ে লোডশেডিং আরও অনেক বাড়াতে হতে পারে। পাশাপাশি পণ্য আমদানি এখন যা কমিয়ে আনা হয়েছে। আইএমএফের অর্থ পেতে বিলম্ব হলে আরও কৃচ্ছতা দরকার হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন— পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। বিশেষ করে আইএমএফ যে প্রক্রিয়ায় কাজ করে তাতে তারা তাদের প্রতিটি শর্তের ক্ষেত্রে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করে না।
উল্লেখ্য, আইএমএফর দলটি চলতি মাসে ঢাকায় কাজ শেষ করার পর ওয়াশিংটন ফিরে গিয়ে তাদের প্রতিবেদন সংস্থার বোর্ডে উত্থাপন করবে। এরপর সেখানে তারা পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করবে এবং পাশাপাশি আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে এমনিতেই দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেতে ডিসেম্বর পার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা
গেল ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড়ের পর থেকেই আলোচনা ছিল আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে কি-না।
সংস্থাটির নির্দেশনা অনুযায়ী, চলতি বছর অন্তত ৪ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করার টার্গেট অর্জন করতে হবে এনবিআরকে। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে সাড়ে ৬১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের যে প্রতিশ্রুতি ঋণ প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশ দিয়েছিল তা অর্জনেও বেশ পিছিয়ে আছে সংস্থাটি।
২০২২-২৩ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। সবমিলিয়ে লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে ১১ শতাংশ কম রাজস্ব আদায় হয়েছিল গত বছর।
আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৬ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম তিনমাসে ৬১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের প্রতিশ্রুতি পূরণেও পিছিয়ে আছে এনবিআর।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, নির্ধারিত হারে ট্যাক্স রেভিনিউ অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে বুধবারের বৈঠকে আইএমএফ মিশনকে অবহিত করা হয়েছে। সফররত মিশনটির সাথে বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
তবে গণমাধ্যমে আসা খবর অনুযায়ী, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে যেসব সংস্কারের পরামর্শ সংস্থাটি বাংলাদেশকে দিয়েছিল সেগুলো কার্যকরে জোরালো পদক্ষেপ এখনি নির্বাচনের আগে নিতে সরকার উৎসাহী নয়।
তবে সরকারের দিক থেকে একাধিকবার আইএমএফকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, নির্বাচনের পর নতুন সরকার এসে এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করবে। এখন ঢাকায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের সময়ও একই বার্তা মিশন