মিরপুর-২ নম্বরে থানার বিপরীতে ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়। ২ জানুয়ারি নতুন বছরের ক্লাস শুরু হলেও সম্ভব হয়নি শিক্ষার্থীদের হাতে সব নতুন বই তুলে দেওয়া। পাঠ্যবই ছাড়াই শিক্ষকরা নতুন কারিকুলামের প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ক্লাস করাচ্ছেন। তাদের পড়ানো হচ্ছে পুরোনো বই থেকে। কবে বই আসবে, তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতেও পারছেন না। ফলে বই ছাড়াই চলছে পাঠদান কার্যক্রম। সে কারণে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও কম দেখা গেছে।
ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ে সরেজমিনে দেখা গেছে, এই বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণির একটি বইও আসেনি। দ্বিতীয় শ্রেণির ৩ বিষয়ের মধ্যে কেবল গণিতের বই এসেছে। ষষ্ঠ শ্রেণির ১০টি বিষয়ের মধ্যে এসেছে ইংরেজি, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জীবন ও জীবিকা, এই ৫ বিষয়ের বই। সপ্তম শ্রেণিতে ১০টি বিষয়ের মধ্যে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত এবং ইসলাম শিক্ষার বই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। তবে অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা ব্যাকরণ, নবম শ্রেণির আইসিটি এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বই ছাড়া অন্যসব বিষয়ের বই পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নতুন কারিকুলামের প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই না পাওয়ায় পুরোনো বই দিয়ে শিক্ষকদের ক্লাস নিতে দেখা গেছে।
এই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র সিয়াম মাহফুজ জানায়, ডিসেম্বরের শেষে স্কুলে ভর্তি হয়েছি। ১ জানুয়ারি স্কুল থেকে পাঁচটি বই দিয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞান এবং ইংরেজি বিষয়ের বই দেওয়া হয়নি। সে কারণে পুরোনো বই দেখে স্যাররা এসব বিষয় পড়াচ্ছেন। কবে বই দেওয়া হবে তা আমাদের জানানো হয়নি।
সপ্তম শ্রেণির সান্তানু বিশ্বাস জানায়, তারা ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত এবং ইসলাম শিক্ষা বই পেয়েছে। তাদেরও আগের বছরের বই খুলে স্যাররা ক্লাস নিচ্ছেন। বই ছাড়া ক্লাসে আসতে আগ্রহ পায় না বলেও জানায় সে।
বাংলার শিক্ষক শাহানাজ পারভিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সপ্তম শ্রেণির বাংলা বই এখনো পাওয়া যায়নি বলে পুরোনো বই দিয়ে শিক্ষার্থীদের ধারণা দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু এখনো সব বই আসেনি তাই কোনোমতো ক্লাস নেওয়া হচ্ছে।
সপ্তম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমে আগের বইয়ের সঙ্গে মিল নেই উল্লেখ করলে তিনি বলেন, হেড স্যার আমাকে বাংলা ক্লাস নিতে বলছেন। এ কারণে আমি পুরোনো বই দেখে ছাত্রদের কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। বই এলে নতুনভাবে পড়ানো হবে।
ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আহমেদ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের যেসব বই দেওয়া হয়েছে তা শিক্ষার্থীদের বিতরণ করেছি। আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে বাকি বই দেওয়ার কথা রয়েছে। যেহেতু ক্লাস শুরু হয়েছে, তাই শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার মধ্যে রাখতে পুরোনো বইয়ের উপর ধারণা দিতে শিক্ষকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মিরপুর-৬ নম্বরে ইসলামিয়া হাইস্কুল। এখানে চাহিদার ৪০ শতাংশ বই পেয়েছেন তারা। তার মধ্যে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির একটি বইও আসেনি। দ্বিতীয় শ্রেণির এসেছে শুধু গণিত বই। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির সব বিষয়ে বই পেলেও চাহিদার তুলনায় কম দেওয়া হয়েছে।
আর মাধ্যমিকে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল প্রযুক্তি, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বই পায়নি। সপ্তম শ্রেণিতে দেওয়া হয়েছে বাংলা চারুপাঠ, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের বই। অষ্টম-নবম শ্রেণির সব বিষয়ের বই এলেও চাহিদার তুলনায় কম বই দেওয়া হয়েছে।
এই স্কুলের শিক্ষক আজাদ হায়দার বলেন, ২০২৩ সালের চাহিদার ৫০ শতাংশ বই আমরা এখানো পাইনি। নতুন কারিকুলামের অনেক বই বাকি রয়েছে। বই না পাওয়ায় আমাদের স্কুলে এখনো ক্লাস শুরু করা হয়নি।
এদিকে আগারগাঁও শেরে বাংলা নগর শিশু শিক্ষা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা সব বই পেলেও অধিকাংশ পাঠ্যবই নিউজপ্রিন্ট কাগজের তৈরি। এমনকি প্রাক-প্রাথমিকের বইও একই কাগজে বানানো হয়েছে। এ কারণে ছবি ও লেখা অস্পষ্ট।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) সামসুর নাহার জানান, এবছর যেসব বই দেওয়া হয়েছে, তার মান খুবই খারাপ। ডিজাইন অনুযায়ী বই তৈরি করা হয়নি। কাভার পেজ নিম্নমানের, কাটিং সঠিক হয়নি, ছাপা ছবি ও অক্ষর কোথাও কোথাও লেপটে গেছে। বই দেওয়ার আগে স্কুলের সিল বইয়ের উপর দেওয়ার সময়ই ছিঁড়ে যাচ্ছে। শিশুরা কীভাবে এক বছর এসব বই পড়বে?
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ওই বিদ্যালয়ে পাঠানো নিম্নমানের নিউজপ্রিন্টের বইগুলো মাস্টার সিমেক্স পেপার প্রেসের তৈরি। যোগাযোগ করা হলে মাস্টার সিমেক্সের মালিক আলী কবির প্রথমে ঢাকায় বই সরবরাহের বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে তথ্য প্রমাণ তুলে ধরলে বলেন, এনসিটিবি নিয়োজিত পরিদর্শন কোম্পানি এই বই সরবরাহের ছাড়পত্র দিয়েছে। মানসম্মত না হলে আমরা ছাড়পত্র পেতাম না।
এবিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, গত ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৮২ শতাংশ বই সারাদেশে পাঠানো হয়েছে। কোথাও কোথাও হয়তো থানা-জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা বিতরণ করতে বিলম্ব করছেন বলে সেখানে বই যাচ্ছে না। এবিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সারাদেশে শতভাগ বই পৌঁছে দিতে নির্দেশনা সব প্রেসগুলোকে দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের পরও যদি কেউ বই পাঠাতে ব্যর্থ হয় তবে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।
নিম্নমানের বইয়ের বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, কাগজ সংকটের কারণে বইয়ের ব্রাইটনে বা উজ্জ্বলতার বিষয়ে কিছুটা ছাড় দেওয়া হলেও জিএসএম (কাগজের পুরুত্ব) বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। আমরা যে এজেন্সির মাধ্যমে বইয়ের মান তদারকির কাজ করিয়েছি, তাদের বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিম্নমানের কাগজের কারণে আমরা অনেক ছাপাখানার বই নষ্ট করেছি। এরপরও কারো বিরুদ্ধে এ ধরনের কাজের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিল আটকসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।