পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক যোগাযোগকে ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান হাইকমিশন “দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বড় পদক্ষেপ” হিসেবে বর্ণনা করেছে। আর এই ঘটনাটি দুই দেশের মধ্যে “ঐতিহাসিকভাবে দুর্বল সম্পর্কে” উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে।
চলতি বছরের আগস্টে গণবিপ্লবের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর থেকে এই পরিবর্তন শুরু হয়েছে। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) রাতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এমনটাই জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
একাত্তরের ছায়া
বাংলাদেশ-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর ১৯৭১ সালের ছায়া অনেকদিন ধরেই প্রকট আকারে ছিল। ১৯৭১ সালে ৯ মাস দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হত্যা, নির্যাতন ও নৃশংসতার স্মৃতি বাংলাদেশের জাতীয় মানসিকতায় গভীরভাবে আঁচড় কেটেছে।
ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষতির জন্য পাকিস্তান কখনোই ক্ষমা চায়নি বা দুঃখ প্রকাশ করেনি। যদিও পাকিস্তান এই বিষয়টিকে মীমাংসিত ইস্যু বলেই উল্লেখ করে থাকে। পাকিস্তান মনে করে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পাকিস্তান প্রকল্প ভাঙার একটি ভারতীয় ষড়যন্ত্র।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই আবেগপ্রবণ একটি বিষয়। (পাকিস্তানের পক্ষ থেকে) “যথাযথ ক্ষমা প্রার্থনা” না করায় ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করা অতীতে কঠিন বলেই প্রমাণিত হয়েছে।
হাসিনা, পাকিস্তান ও ভারত
পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঢাকার কিছু সরকারের অধীনে তিক্ত হয়েছে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার অধীনে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন (১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০২৪) তিনি ১৯৭১ সালে “যুদ্ধাপরাধের দায়ে” “সহযোগী” বা রাজাকারদের নির্মমভাবে বিচার করেছিলেন।
তিনি “যুদ্ধাপরাধীদের” বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন এবং ২০১৩ সালে এই ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করে। হাসিনার শাসনামলে ফাঁসি কার্যকর হওয়া অনেক বিরোধী নেতার মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রথম।
আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডকে পাকিস্তানের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান খুবই দুর্ভাগ্যজনক বলে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “এতে কোনো সন্দেহ নেই যে— ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রতি তার আনুগত্য এবং সংহতির কারণে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে”।
একইসঙ্গে হাসিনা বাংলাদেশকে ভারতের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন। হাসিনা নিজে নেহেরু-গান্ধী পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক রাখতেন এবং ১৯৭৫ সালে তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তাকে নয়াদিল্লিতে আশ্রয়ও দেওয়া হয়েছিল।
পাকিস্তানের জন্য নতুন সূচনা
সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের দাবি, গত আগস্টে ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণআন্দোলনে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময় আশপাশে ঘটা তিনটি ঘটনা এখন যা ঘটছে সেই প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য।
প্রথমত, হাসিনা দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তার দল ও পরিবারের অবদান থেকে রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছেন। কিন্তু ছাত্রদের বিক্ষোভ সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে— বিক্ষোভ ও প্রতিবাদকারীদের রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করার কৌশল কোনো কাজই করেনি।
দ্বিতীয়ত, নয়াদিল্লির সঙ্গে হাসিনার “অতি ঘনিষ্ঠ” সম্পর্কের জন্য বাংলাদেশিদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভও ছিল। অনেকে মনে করতেন, বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত খুব বেশি করে জড়িয়ে পড়ছে এবং হাসিনার প্রতি প্রকাশিত ক্ষোভকে “ভারত-বিরোধী” মনোভাব হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, গত আগস্ট মাসে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজধানীতে চালু থাকা ভারতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে (আইজিসিসি) ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা।
তৃতীয়ত, সংখ্যালঘু নিয়ে বাংলাদেশে সর্বদাই একটি আখ্যান বা বর্ণনা বিরাজমান আছে। আর সেটি ১৯৭১ সালের ঘটনাকে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে নয় বরং মুসলিম জাতির ট্র্যাজেডি এবং দেশভাগের প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। ঢাকায় হাসিনা-পরবর্তী সরকার ব্যবস্থায় ইসলামপন্থি জামায়াতে ইসলামীর শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে।
আর এই সব বিষয়ই বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হাত প্রসারিত করার জন্য পাকিস্তানের পক্ষে আদর্শ পরিস্থিতি গড়ে তুলেছে। শেখ হাসিনার ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পরের মাসগুলোতে একাধিক পাকিস্তানি সম্পাদকীয় ও মতামত-প্রবন্ধগুলোতে এই বিষয়টি উল্লেখও করা হয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি কূটনীতিক বুরহানুল ইসলাম নিউজ পোর্টাল প্যারাডিজম শিফটে লিখেছেন, “স্পষ্টতই এখন সময় এসেছে বাঙালি এবং বাংলাদেশের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার… ১৯৭১ সালের তিক্ত অনুভূতিগুলোকে সরিয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয়েরই তাদের সম্পর্ক পুনর্গঠন করা উচিত।”
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারও এখন পর্যন্ত ইসলামাবাদের বিভিন্ন প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সাথে বৈঠক করেন।
ওই বৈঠকে উভয় নেতা দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা পুনরুজ্জীবিত করার এবং উভয় দেশের সম্পর্কের “নতুন অধ্যায়” শুরু করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।