যে কোনো দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার এবং সাধারণ মানুষের জীবনমান সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও তা-ই। এ দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে দেশের অর্ধ শতকেরও বেশি সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একক নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী হলেন গভর্নর।
গত ২৯ ডিসেম্বর স্থানীয় একটি হোটেলে বণিক বার্তা আয়োজিত অর্থনেতিক সম্মেলনে আমাদের ৫০ বছরের অর্থনীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে আমন্ত্রিত বক্তারা আলোচনা করেন। সে আলোচনা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মপরিধি সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে। সে সময়ে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল মাত্র ৬৩০ কোটি ডলার। আর এখন জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি ডলারে (তবে ভিন্ন সূত্র বলছে, ৩৫ হাজার কোটি ডলার)। ১৯৭২ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৪ কোটি ডলার। বর্তমানে তার আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলারে। যদি সে সময়কার জনসংখ্যাকে আমলে নিই তাহলে বলতে হবে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশ এখন ১৭ কোটি মানুষের। তারপরও দেখতে হবে ১৯৭২ সালে আমাদের মোট খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি মেট্রিক টন। এখন আমরা উৎপাদন করছি প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ মেট্রিক টন। নীতিনির্ধারকরা প্রত্যাশা করছেন, বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ আজকের ৪১তম অবস্থান অতিক্রম করে ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। আর সব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূলে থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আলোচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পাঁচ দশকের কর্মপরিধিকে ছয়টি পর্বে বিভক্ত করা হয়। প্রথম পর্বটি হলো ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল। স্বাধীন দেশ হিসাবে প্রয়োজন ছিল কৃষি ও শিল্প খাতের গতি ত্বরান্বিত করা। বাংলাদেশ ব্যাংক এ সময়ে এই দুটি খাতে ঋণ সরবরাহের ব্যবস্থা করে, যাতে করে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয়করণ অধ্যাদেশ জারি করার পাশাপাশি কৃষি ব্যাংক ও শিল্প ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে এ দুই খাতে ঋণ সরবরাহের কাজ শুরু করে। দ্বিতীয় পর্ব হিসাবে ধরা হয়েছে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৯ সাল। এ পর্বটিকে বলা হয়েছে বাজারমুখী ব্যাংক ব্যবস্থা প্রণয়ন পর্ব। আজকে ব্যাংক ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের যে সরব উপস্থিতি এর শুরুটা ছিল এই পর্বে। আর্থিক খাতে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন তা নিরূপণে এবং প্রাথমিক পর্যায়গুলো চিহ্নিত করার জন্য গঠন করা হয় মানি ব্যাংকিং ও ক্রেডিট কমিশন। এর পরের দশকটি ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত।
এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের তৃতীয় পর্ব। এই পুরো পর্বটিকে ধরা হয় আর্থিক খাত সংস্কারের কাল হিসাবে। এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহারকে জনবান্ধব করা বা নিম্নমুখী করার কাজে হাত দেয়। কোন কোন খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তা চিহ্নিত করার কাজটি করা হয়। এ পর্বে গঠন করা হয় ব্যাংক রিফর্ম কমিটি। মোটামুটি সংস্কারের একটি বড় অংশ সম্পাদন করা হয় তৃতীয় পর্বে। চতুর্থ পর্ব হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময়কে। এ পর্বে আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনাকে সুদৃঢ় করার কাজে মনোনিবেশ করা হয়। আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে অধিকতর দক্ষ করার জন্য বেশকিছু নতুন পলিসি নেওয়া হয় এ পর্বে। পঞ্চম পর্বটি ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। এ সময়টাতেই বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করে।
ষষ্ঠ বা শেষ পর্বটি ২০১৭ সালের পর থেকে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ পর্বটিকে বলা হচ্ছে-আর্থিক খাতে জালিয়াতি প্রতিরোধ, গ্রাহক স্বার্থরক্ষা ও কোভিড মোকাবিলার পর্ব। চলমান কোভিড বিপর্যয় থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে সরকার যে চারটি নীতি-কৌশল ঘোষণা করেছে তার দুটি, অর্থাৎ স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা এবং বাজারে অর্থের সরবরাহ বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা পালন করছে। সব মিলে গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সোশ্যালি রেসপন্সিবল ফাইনান্সিং (এসআরএফ), বাধ্যতামূলক কৃষি ঋণ, শস্যের বহুমুখীকরণ, আমদানির বিকল্প সংস্থান ও এসএমইর জন্য বিশেষ ঋণ, এসএমই ফিন্যান্স, গ্রিন ফাইন্যান্স, এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ফাইন্যান্স, পেমেন্ট ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশনসহ নানা উদাহরণ দেওয়া যায় এবং তা বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করতে পারে। আমরা সে কৃতিত্ব বাংলাদেশ ব্যাংককে দিতে কুণ্ঠিত নই এবং এ প্রতিষ্ঠানের উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করি।
তারপরও বলার মতো কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। আগেই বলেছি, শেষ পর্বটি বা চলমান পর্বটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করার পর ২০১৬ সালে এসে আমরা একটি বড় ধরনের অঘটনের শিকার হয়েছি। ওই বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৭০০ কোটি টাকা) হ্যাকাররা হ্যাক করে ফিলিপাইনে পাচার করে দেয়। এর জন্য এককভাবে কোনো ব্যক্তিকে দায়ী না করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক দায় এড়াতে পারে না। আমাদের দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে সমগ্র ব্যবস্থাপনাকে আরও বেশি শক্তিশালী করার প্রয়োজন আছে।
ব্যাংক খাতে বেআইনিভাবে ঋণ দেওয়া-নেওয়া বেড়েছে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিদ্যমান। এ বিষয়ে যুগান্তর বলছে, ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত হয়। কিন্তু বিচার হয় না। এতে দুর্নীতি আরও বেড়ে যায়। একাধিক ব্যাংক এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে চলে যাচ্ছে। বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই। ঋণ দেওয়ার একটা সীমা অছে। সে সীমা অতিক্রম করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকও সে ঋণে সায় দিচ্ছে। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েও অনেকে ঋণ নেন। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেআইনিভাবে ঋণ দেওয়ার কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে, যার ফলে ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। এরই মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অবলোপিত ঋণ আছে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর নজরদারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে নেপাল একটি উদাহরণ হতে পারে।
ছোট্ট অর্থনীতির এ দেশটিতে কোনো ব্যক্তি খেলাপি হওয়ার পরদিন থেকেই পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। আমরা এর ধারেকাছেও যেতে পারিনি। উপরন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ ও ২০১৪ সালে ইচ্ছাকৃত শীর্ষ ১০ খেলাপি গ্রাহককে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এর জন্য রাষ্ট্রকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এর দায় বাংলাদেশ ব্যাংক এড়িয়ে যেতে পারে না। অর্থ পাচার রোধেও বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক, কাস্টমস ও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ সম্মিলিতভাবে কাজ করলে অর্থ পাচার বন্ধ করা সম্ভব। যদিও এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার প্রয়োজন আছে। তারপরও ব্যাংক উদ্যোগী হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আর্থিক অনিয়ম প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখা। কেবল জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিয়ে সফলতা পাওয়া যাবে না, যদি না আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম দূর করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি কামনা করছি।