ছিল প্রতিবন্ধকতা, ছিল সীমাবদ্ধতা। ষড়যন্ত্রেরও কমতি ছিল না। কিন্তু সব বাধা জয় করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। নিজ অর্থে বিশাল এ সেতু বানিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে বাংলাদেশ। স্বপ্নিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল শনিবার (২৫ জুন) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন পদ্মা সেতুর। পরদিন (২৬ জুন) ভোর ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। ওইদিন থেকেই সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
ক্ষমতাসীনরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ থেকে ১.৫ শতাংশ। এর প্রভাবে পাল্টে যাবে দেশের সার্বিক চিত্র। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেতু শুধু চালু হলেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে না। সেতুর দুই পাড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। যাতে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যত বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে জিডিপিতে এর অবদান তত পড়বে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে। এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে। মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হতে পারবে। গড়ে উঠবে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড)। পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। সারাদেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তাদের মতে, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ২১টি জেলা তিনটি বিভাগের অন্তর্গত। দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকলেও বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব জেলায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা চলছে। দেশে বর্তমানে আটটি ইপিজেড ও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু আছে। এর মধ্যে পদ্মার ওপারে রয়েছে শুধু মোংলা ইপিজেড। পদ্মা সেতু ঘিরে যশোর ও পটুয়াখালীতে আরও দুটি ইপিজেড করার প্রস্তাব আছে।
এছাড়া মোংলা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও পায়রা বন্দর এলাকায় চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। দুই বছর আগে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলায় একটি তাঁতপল্লি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ১২০ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠছে ওই তাঁতপল্লি। সেখানে আট হাজার ৬৪টি তাঁত শেড হবে। এদিকে, মুন্সিগঞ্জে বিসিকের চারটি প্রকল্পের কাজ চলমান। সেগুলো হলো- প্লাস্টিক শিল্পকারখানা, রাসায়নিক শিল্পকারখানা, মুদ্রণশিল্প ও এপিআই শিল্পপার্ক। আছে বেশ কয়েকটি নতুন প্রকল্পও। ফরিদপুরে ৫০০ একর জায়গায় শিল্পপার্ক, খুলনায় ৫০০ একর জায়গায় শিল্পপার্ক, নড়াইলে ২০০ একর, মাগুরায় ২০০ একর জায়গায় শিল্পপার্ক এবং গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ২০০ একর জায়গায় একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করারও চিন্তা আছে সরকারের।
সরকারের এমন কর্মযজ্ঞ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর ফলে আমাদের ভৌগোলিক বিভাজন যেটা ছিল, সেটা দূর হবে। বাংলাদেশ একটা একীভূত অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হবে। পদ্মা সেতুর ফলে আমাদের বিনিয়োগ, বিতরণ, বিপণন ব্যবস্থা আরও সাশ্রয়ী হবে। এগুলো আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এছাড়া ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু ঘিরে বিনিয়োগের বিভিন্ন সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। এসব বিনিয়োগ নানামুখী কর্মসংস্থান তৈরি করবে এবং দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে আমরা মনে করছি।’
‘পদ্মা সেতুর সঙ্গে সঙ্গে যেগুলো হওয়ার কথা; বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক— এগুলোও হতে হবে। এজন্য আমাদের দক্ষ জনশক্তি প্রস্তুত করতে হবে। সুতরাং সেতু খোলার পরবর্তীতে যে কাজগুলো করার কথা সেগুলো করতে পারলে সম্ভাব্য জিডিপিতে যে অবদান সেটা অনেক বেশি হবে। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী ১.২ প্রবৃদ্ধি বাড়বে। তবে এটা বেশিও হতে পারে।’
যদি আমরা অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারি তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হবে। তবে, এটা অটোমেটিক্যালি (স্বয়ংক্রিয়ভাবে) হবে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিনিয়োগ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, পর্যটন খাতের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে হবে— বলেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে মাত্রাটা কী পরিমাণে হবে সেটার বিষয়ে আমি এখন বলতে পারব না। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনসাধারণ উপকৃত হবেন। এ অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষিপণ্যসহ অন্যান্য জিনিসপত্র রাজধানীর বড় বড় বাজারে সহজে সরবরাহ করা যাবে। দীর্ঘদিনের যোগাযোগের অনিশ্চয়তা দূর হবে।’
‘এখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কাঁচামাল ও শ্রমিকদের ওপর নির্ভর— এমন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে পারে সরকার। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও বাড়বে। যার প্রভাব দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর পড়বে। সবমিলিয়ে আমি মনে করি, পদ্মা সেতু অত্যন্ত ইতিবাচক হবে আমাদের জন্য।’
পদ্মা সেতু চালু হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ থেকে ১.৫ শতাংশ বাড়বে— সরকারের এমন ঘোষণা প্রসঙ্গে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমার পক্ষে ফিগার বলা সম্ভব না। তবে, সরকারের এ ঘোষণা আমার কাছে বাস্তব বলেই মনে হয়। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। উৎপাদন, উৎপাদনে বৈচিত্র্যকরণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণ— এগুলো করতে হবে।’
পদ্মা সেতু চালু হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.৩ শতাংশ বাড়বে— এমন দাবি করে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগাযোগ ঘটবে। ফলে এসব অঞ্চলের পণ্য সহজেই ঢাকায় প্রবেশ করবে। শুধু পণ্য নয়, বিপুলসংখ্যক মানুষও আসা-যাওয়া করবেন। সৃষ্টি হবে ব্যাপক কর্মকাণ্ড। পণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত হবে। বাজারে চাহিদাও বাড়বে। আমাদের ওয়াইডার (বিস্তীর্ণ) ইকোনমিক মার্কেট আরও ইন্টিগ্রেটেড (সমন্বিত) হবে।’
‘অর্থনৈতিক এসব কর্মকাণ্ডের প্রভাব সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে পড়বে। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.৩ শতাংশ বাড়বে। এছাড়া কর্মসংস্থানও বাড়বে। এলাকার বেকারত্ব দূর হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়ে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।’
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষদের জন্য সরকারের কী কী পরিকল্পনা আছে— জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পরিকল্পনা তো অনেক আছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, পর্যটন খাত— এগুলো তো রয়েছে। এসব অবকাঠামো তৈরি হলে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে বিনিয়োগ বাড়বে। এজন্য সরকার ও বেসরকারি খাত একসঙ্গে কাজ করবে।