চট্টগ্রামের পটিয়াজুড়ে চলছে হুইপ শামসুল হক চৌধুরী পরিবারের অপরাধ সাম্রাজ্য। হুইপের পুরো পরিবার অক্টোপাসের মতো গিলে খাচ্ছে পটিয়া ও তার আশপাশ এলাকাকে। প্রতিটা সেক্টর ভাগ করেই চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি। অন্ধকার এ রাজ্যের ‘রাজপুত্র’ হিসেবে রয়েছেন হুইপপুত্র নাজমুল হক চৌধুরী শারুন। ‘অঙ্গরাজ্যে’র রাজ্যপাল হিসেবে রয়েছেন হুইপের দুই ভাই নবাব, মহব্বত এবং বোন রেখা। বাদ যাননি ভাগ্নে কিংবা নিকটাত্মীয়রাও। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে হুইপ পরিবারের এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পটিয়ার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা অভিযোগ করেন, ‘পটিয়ায় হুইপ পরিবারের বাইরে গিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ নেই কারোর। টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে উন্নয়ন কাজে ইট, বালু পাথর সরবরাহ সব কিছুই করেন হুইপ পরিবারের সদস্যরা। বালু মহাল নিয়ন্ত্রণ, শিল্প কারখানায় কাঁচামাল ও শ্রমিক সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ, কথিত সালিশ বিচারের নামে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ সব কিছুই করছে তারা। তাদের এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললেই চলে হামলা ও মামলা।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, শামসুল হক চৌধুরী টানা দ্বিতীয় বার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে পটিয়া এলাকায় অপরাধ জগতে ডালপালা মেলতে থাকে তার পরিবার। জাতীয় সংসদের হুইপ নির্বাচিত হওয়ার পর তা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে। এরপর থেকে এলাকার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন কাজে রড, বালু, পাথর সরবরাহ, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, শিল্প কারখানায় কাঁচামাল ও শ্রমিক সরবরাহ, মাদক ব্যবসাসহ সব সেক্টরে ভাগ বসায় হুইপপুত্র ও তার ভাই-বোনেরা। এসব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনার নেপথ্যে থাকার অভিযোগ রয়েছে হুইপ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। হুইপ সাম্রাজ্যের রাজপুত্র হিসেবে রয়েছেন নাজমুল হক চৌধুরী শারুন। এলাকায় টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন গ্রহণ, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য অপরাধী চক্রকে লালন-পালনের অভিযোগ রয়েছে শারুনের বিরুদ্ধে। পটিয়ার ইন্দ্রপুল, মেলিটারিপুল এবং ভেল্লাপাড়া এলাকায় বড় বড় তিনটি বালু মহালের নিয়ন্ত্রণেও রয়েছেন শারুন।
একটি বেসরকারি জাহাজ তৈরি ইয়ার্ড দখলের অভিযোগ রয়েছে হুইপপুত্রের বিরুদ্ধে। হুইপের ভাই ফজলুল হক চৌধুরী মহব্বতের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। বিরোধপূর্ণ জায়গা-জমি দখল, সালিশ-বিচারের নামে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ, থানা ও উপজেলা প্রশাসনে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে মহব্বতের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া দক্ষিণ পটিয়ার পাঁচ ইউনিয়নের আবাদি ভূমির টপ সয়েল বিক্রি সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন তিনি। প্রতিদিন শতাধিক টপ সয়েল বহনকারী ট্রাক থেকে ৪ হাজার টাকা হারে চাঁদা নেন তিনি। হুইপ সাম্রাজ্যের বাস্তবিক অর্থে ‘নবাবের’ ভূমিকায় রয়েছেন আরেক ভাই মুজিবুল হক চৌধুরী নবাব। পারিবারিক নানা ইস্যু নিয়ে একসময় নবাবের সঙ্গে দূরত্ব ছিল শামসুল হকের। কিন্তু ২০১৬ সালে বিরোধ ভুলে হুইপ সাম্রাজে যোগ দেন নবাবও। এরপর থেকে শুরু হয় তার বেপরোয়া কর্মকান্ড। এলাকার মাটি ভরাট সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে ইট, বালু, সিমেন্ট, পাথর সরবরাহ, পটিয়ায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিল্প কারখানায় শ্রমিক সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করেন নবাব। পটিয়ায় গড়ে ওঠা শিল্প কারখানাগুলোকে কাঁচামাল কিনতে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শিল্প কারখানায় কর্মকর্তা শ্রমিক বহন করার জন্য গাড়িও নিতে হয় তার কাছ থেকে।
এসব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কমপক্ষে পাঁচ নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। এসব ঘটনার নেপথ্য হোতা হিসেবে নবাবকে দায়ী করা হয়। এ ছাড়া পটিয়ার জঙ্গলখাইন ইউনিয়নে ভূমি দখল করে নবাব গড়ে তুলেছেন বিশাল কৃষি খামার। যাতে তিনি বিনিয়োগ করেছেন কোটি কোটি টাকা। হুইপ-ভাইদের চেয়ে কোনো অংশে কম যান না হুইপের বোন রেখা। তার বিরুদ্ধে রয়েছে সংখ্যালঘুদের জায়গা দখল, থানায় সালিশ বিচারে প্রভাব বিস্তার এবং বিভিন্ন শিল্প কারখানার শ্রমিক বহনকারী পরিবহন নিতে বাধ্য করার অভিযোগ। মামা খালার চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই হুইপ-ভাগ্নে লোকমান খান। তার বিরুদ্ধে রয়েছে উপজেলা ও পৌরসভার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, জায়গা দখল-বেদখল এবং মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ।