বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত ভাগ করেছে মহানন্দা নদী। ওই এলাকার অধিকাংশেরই জীবন-জীবিকা মহানন্দার ওপর নির্ভরশীল। দিনভর কঠিন শ্রমে তারা নদীর বুক থেকে তুলে আনে ঝুড়ি ঝুড়ি পাথর। সন্ধ্যায় মহাজনের কাছে বিক্রিলব্ধ অর্থে আহার জোটে স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজনের। মহানন্দার এই পাথরে এভাবেই জীবন নির্বাহ হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমিকের।
শুধু এই নদী নয়, পঞ্চগড়ের উপর দিয়ে বয়ে চলা করতোয়া, ডাহুক, তালমা নদীতে পাওয়া যায় দেশের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের ঝকঝকে, মোটা ও লালচে বালি। তিনটি নদীর ১৫ টি বালুমহাল প্রতি বৈশাখে ইজারা দেয় প্রশাসন। দেশের সবচেয়ে ভাল মানের বালু হওয়ায় সারাদেশেই ট্রাক যোগে যাচ্ছে প্রতিদিন৷। এছাড়া বালু শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রমিকের। জেলার নিম্ন আয়ের ১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রমিকের। কেউ নদী থেকে পাথর উত্তোলন করছেন। আবার কেউ লোড আনলোডের কাজ করছেন। আবার কেউ পরিবহণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। দিনভর হাড়ভাঙা কাজ করে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত আয় করে সংসার চলছে এই শ্রমিকদের।
বালু ইজারাদারের অধিনে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাজার হাজার শ্রমিক নদীর হাঁটুজল থেকে বালু তুলে নৌকায় করে ঘাটে নেন। বালু তোলার সময়ই বালুভেদে আলাদা আলাদা ক্যাটাগরিতে পৃথক স্থানে রাখা হয়। সেখান থেকে ট্রলিতে করে নেয়া হয় ব্যবসায়ীদের নিজ নিজ বালু পয়েন্টে। পরে তা ট্রাকে লোড করে চলে যায় দেশের বিভিন্ন জেলায়।
অন্যদিকে, মহানন্দা করতোয়া নদী যেন শ্রমিকদের নতুন করে ভাগ্যে খুলে দিয়েছে বালি আর নুড়ি পাথর। বর্ষার প্রবল বর্ষণে দূ’কূল প্লাবনে নদীর শ্রোতের সাথে ভেসে আসে ছোট, বড় এবং মাঝারি আকারের নুড়ি পাথর আর বালু। এই বালু- পাথরেই জড়িয়ে গেছে এ উপজেলার ৫০/৬০টি গ্রামের প্রায় কয়েক হাজার মানুষের জীবন। মহানন্দার পাথরেই হয়েছে এসব মানুষের কর্মসংস্থান। জীবন মান উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের নানা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে মহানন্দার এই নুড়ি পাথর।
শ্রমিকদের এই ঘাম ঝরানো শ্রমে উত্তোলিত পাথর দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গড়ে উঠছে নামিদামি দালান-ইমারত। উচু-উচু বিল্ডিং। দেশের কারুকার্য সৌন্দর্য বিলাসময় শহরের ফ্ল্যাট গড়ে উঠলেও এদের ভাগ্যে জুটে না নিজেদের ঘরের দেয়ালটা পাথরের প্রাচীর গড়তে। বর্ষার প্লাবনে নদী এই নদীগুলোকে জাগিয়ে তুললেও চৈত্র-বৈশাখে এ নদী অনেকটা মরা নদীতে পরিণত হয়। উজানে ভারতের বাঁধ দিয়ে নদীর গতি প্রবাহকে আটকে দেওয়ার ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। অনেক স্থানে ভরা বর্ষাতেও থাকে হাটু পানি । এর ফলে জাগছে চর। অনেকে আশংকা করছেন আর কিছুদিন পরেই হারিয়ে যাবে এসব নদী। ফলে হয়ত বেকার হয়ে পড়বে হাজার হাজার মানুষ।
নদীর পানি কমে যাওয়ায় শনিবার (২৯ এপ্রিল) সরেজমিনে দেখা যায়,কয়েক কিলোমিটার জুড়ে শ্রমিকরা দল বেঁধে স্লাব তৈরি (গর্ত) করে পানির নিচ থেকে এই নুড়ি পাথর সংগ্রহ করছেন।সে-সব পাথর ঘাটে নেওয়ার জন্য কেউ কেউ বাতাসে ফুলানো ট্রাকের চাকার টিউবলোহার চালানি ব্যবহার করে। আবার কেউ ঢাকিতে পাথর ঘাটে নিয়ে আসেন। বছরের প্রতিদিনই চলে পাথর সংগ্রহের কাজ। এরপর স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে এই পাথর বিক্রি করেন তারা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন এই পাথর । এরপর বড় ব্যবসায়ীরা সারাদেশে সরবরাহ করে থাকেন। গভীর শীত আর বন্যা হলেই কেবল থেমে যায় পাথর সংগ্রহ । সারাদিনে একজন শ্রমিক গড়ে ১৫-২০ সিএফটি পাথর উত্তোলন তুলতে পারেন। সে-সব পাথর মাহাজনের নিকট বিক্রি করে। তবে সারাদিনে শ্রমিকদের পকেটে আসে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এ কারণে পাথর ও শ্রমের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ শ্রমিকদের।
কথা হয় পাথর শ্রমিক রবিউল ইসলামের সাথে। তিনি জানান, বর্তমানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় বিপাকে পড়েছি। মহানন্দায় সারাবছরই পাথর তুলে পরিবার-পরিজনদের নিয়ে বেঁচে আছি। তবে এখন আর আগের মতো মিলছে না পাথর। কনডাক্টররা আমাদের পাথরের ন্যায্য মূল্য দিচ্ছে না। পাথরের মূল্য বাড়লে ভাল হয়।
উপজেলা সদরের সদ্দারপাড়া গ্রামের শাহাদাত হোসেন,জহিরুল ইসলাম, জামাল উদ্দিন নামে শ্রমিকদের সাথে, ভাই হামার কষ্ট কেউ বুঝিবেনি। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কাজ করছু কিন্তু কামের দাম একবারে কম। সারাদিন কাজ করে পাছু (স্থানীয় ভাষা) পাঁচশত টাকা। আর এ নদীতে পাথর তুলতে হয় জীবনটা হাতে নিয়ে। কখনো কখনো ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) জোরদার টহল, মারধর, বাঁধা আবার কখনো গুলি বর্ষনে কাল হয়ে দাঁড়ায় সব কিছু। থমকে যায় জীবন। কয়েক দিন পাথর তুলতে না পারলে তিনবেলা খাওয়া জুটে না। মনে হয় এ যেন সত্যিই পাথুরের জীবন।
তেঁতুলিয়া উপজেলার পাথর ব্যবসায়ী কাজী রাহেল বলেন,এলাকার হাজার হাজার মানুষের জীবিকার সন্ধান দিয়েছে সীমান্ত মহানন্দা নদী । শ্রমিকরা জীবিকার সন্ধানে কষ্ট করে বালু-পাথর মহানন্দা নদীতে থেকে উত্তোলনের কাজ করে। তবে শ্রমিকদের জীবন বড়ই কষ্টের। আমরা যতটুকু সম্ভব বাজার রেট দেওয়ার চেস্টা করি।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, সীমান্তবর্তী এ উপজেলায় তেমন কোনো শিল্প কারখানা গড়ে না ওঠায় কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। সরকারিভাবে এ উপজেলায় বাসস্থানের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি নানাভাবে সরকারি অনুদানের আওতায় আনা হচ্ছে তাদের। প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এসব মানুষের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে।