নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার এক গ্রামে বিয়ে-জন্মদিন বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে গান-বাজনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গ্রামে কেউ গান-বাজনা করলে তাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। তিন দিন আগে উপজেলা সদরের গছিখাইর গ্রামের মানুষ মিলে এই নিয়ম চালু করে।
তবে সংস্কৃতিকর্মীরা এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পাশাপাশি এ নিয়ম জারি করা ব্যক্তিদের সামাজিক রীতিবিরোধী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
এদিকে, গ্রামের কয়েকজন এ বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট করলে নানা রকমের আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। গছিখাইর গ্রামের বদিউজ্জামান ও জামাল মিয়া গত সোমবার এ নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করলে দেশে-বিদেশের অনেকের চোখে পড়ে। নানা সমালোচনার মুখে পরদিন তিনি পোস্টটি ডিলিট করে দেন।
নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্টে বদিউজ্জামান লিখেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, গছিখাইর গ্রামের সম্মানিত মাতাব্বরগণ সম্মিলিতভাবে এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, হিন্দুয়ানি প্রথা কুসংস্কার বাদ্য-বাজনা আর কাহারও বিবাহে আর কোনো দিন আনতে পারবে না। আনলে ২০ হাজার টাকা জরিমানা। সৌজন্যে গছিখাইর গ্রামবাসী।’
গ্রামের বাসিন্দা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহকারী বদিউজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, আমাদের ছোট গ্রাম। গ্রামের সবাই ধর্মপ্রাণ মানুষ। বিয়ে-জন্মদিন বা সুন্নতে খতনা অনুষ্ঠানে চার-পাঁচটা বড় বড় সাউন্ড বক্স লাগিয়ে পোলাপান, পুরুষ-মহিলা সবাই নাচে। শব্দে হার্টের রোগী, বৃদ্ধরা কষ্ট পান। তাই গ্রামের সবাই মিলেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গ্রামের সবাই যেহেতু মুসলমান, তাই এ নিয়ে সমস্যা হয়নি। কেউ এর বিরোধিতা করেনি। ফেসবুকে কেউ সমালোচনা করেনি। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলেছেন। তবে আজ থানা-পুলিশ জানতে চেয়েছিল কেন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি গ্রামের সবার সিদ্ধান্ত বলে তাদের জানিয়েছি। এ সিদ্ধান্ত সবার স্বার্থেই।
গ্রামের মাতব্বর হামিদ আলী বলেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ঘিরে সাউন্ড বক্সের শব্দে গ্রামের সবাই অতিষ্ঠ। তাই সবাই মিলেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত কেউ এ বিষয়ে কোনো সমালোচনা করেছে বলে আমার জানা নেই।
এদিকে, সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার বলেন, এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে আমাকে কেউ কিছু জানায়নি, পরে শুনেছি। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ঘিরে সাউন্ড বক্সের শব্দে রোগী বা বৃদ্ধদের অবস্থা বিবেচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জেনেছি। তবে গ্রামে জারি-সারি, গান, নাটক, যাত্রাপালা বা সংস্কৃতি চর্চা হয়। সেসব বন্ধ করা ঠিক হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম আবু ইসহাক বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম রবিকুল হাসান বলেন, শুনেছি গ্রামের কিছু যুবক রাতে সাউন্ড বক্সে উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে নেশা করে। তাই গ্রামবাসী এসব নিষিদ্ধ করেছে। সংগীত, নাটক, যাত্রাপালাসহ সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ করা বেআইনি। এটা তারা করতে পারেন না। বিষয়টি ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।
জেলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তানভীর জাহান চৌধুরী এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিয়ে-জন্মদিনে গান-বাজনা এসব আমাদের সামাজিক আচার ও সংস্কৃতির অংশ। এসব অনুষ্ঠানেই কেবল সব ধর্মের মানুষ একত্র হতে পারে। ওই গ্রামের লোকজন মূলত ধর্মের দোহাই দিয়ে সামাজিক আচার, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিনাশ করতে চাইছে। সংগীত, নাটক, যাত্রাপাল, জারি-সারি, বিয়ে-জন্মদিনসহ আমাদের যত সংস্কৃতি চর্চা আছে সবই থাকতে হবে। মন্দিরে উলুধ্বনি হবে, মসজিদে আজান হবে, গির্জায় প্রার্থনা হবে। থাকবে সব রকমের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চাও। নিয়ম করে এসব বন্ধ ধর্মীয় গোঁড়ামি ছাড়া কিছুই না। বিষয়টি গুরুত্বসহ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।