দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই রাজনীতির ময়দান উত্তপ্ত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে প্রতিনিয়ত সভা-সমাবেশের কর্মসূচি দিচ্ছে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে একমত বিরোধী দলগুলো।
অন্যদিকে সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন হবে জানিয়ে অনড় অবস্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। এমন পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। দেশটি কি ক্ষমতাসীন ‘আওয়ামী লীগের পক্ষ’ নেবে, নাকি ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকা পালন করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
‘অবাধ ও সুষ্ঠু’নির্বাচনে সরকারকে বারবার তাগিদ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে ইতোমধ্যে ভিসানীতিও ঘোষণা করেছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটি। দেশটি জানিয়েছে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের আমেরিকান ভিসা দেওয়া হবে না। এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনে কী ধরনের ভূমিকা নেয় সেদিকে দৃষ্টি রয়েছে অনেকের।
আরও পড়ুন: নির্বাচনী প্রস্তুতি বিএনপির, গুরুত্ব পাচ্ছেন কারা?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদিও নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রতিবেশী ভারতের ‘ভূমিকা’এতে প্রভাব ফেলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকায় ভারতের অবস্থান এখন ‘বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ’।
২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরেও ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে জোরাল সমর্থন দিয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব বিগত দুটি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আপত্তি তোলেনি।
সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ‘পক্ষ নিয়ে’ যুক্তরাষ্ট্রকে কূটনীতিক বার্তা দিয়েছে দেশটি। বিষয়টি নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পরস্পরবিরোধী প্রতিক্রিয়া এলেও পক্ষপাতের বিষয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিশ্চিত কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি।
তবে নির্বাচন ইস্যুতে মার্কিন ভিসানীতি ও তৎপরতাকে স্বাগত জানিয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমে দেশটির ‘অবস্থান’ নিয়ে প্রকাশিত খবরে আপত্তি দেখিয়েছে দলটি। কারণ হিসেবে দিল্লির সবশেষ তৎপরতা এবং অতীতের ভূমিকা তুলে ধরেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের ঢাকা সফর এবং জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, ‘সুজাতা সিং এরশাদকে বলেননি যে আপনি যদি নির্বাচনে না যান বিএনপি ক্ষমতায় আসবে’।
এ সম্পর্কিত খবর পড়ুন: ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ দশা বিএনপি নেতাকর্মীদের
গয়েশ্বর বলেন, গেল সপ্তাহেই তো ভারতের পররাষ্ট্র দফতর একটা প্রেসনোট দিল যে যথাসময়ে সংবিধান মতো বাংলাদেশে নির্বাচন হবে। তিনি এই কথা বলে কেন? একথা এদেশের সরকারই বলতেছে, তার বলার দরকার কী?
এরপরেও কী আর বলতে হবে কিছু?
বিএপির এই নেতা মনে করেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত ভারসাম্য রক্ষা করছে না। গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সারা বিশ্বের মতো একই সুরে কথা বলবে। এটাই আমার ধারণা ছিল। তাইলে হয়তো বা আমাদের দেশের মানুষ ভোটাধিকার ফেরত পেতে সহজ হইত।
গয়েশ্বর অভিযোগ করেন, ভারত বাংলাদেশের বন্ধু না হয়ে শুধু একটি দলের বন্ধু হয়েছে। তারা একটা দলের বন্ধু। একজন ব্যক্তির বন্ধু। এ অবস্থানটা কোনোভাবেই জনগণের জন্য কাম্য না। ভারত তো চায় আওয়ামী লীগ আজীবন ক্ষমতায় থাকুক, যেভাবে খুশি, এটা তো সুস্পষ্ট।
এদিকে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। এনিয়ে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। তবে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান সরকারি দলের জন্য অনেকটা ‘স্বস্তির’ বলেই মনে করা হচ্ছে।
সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী মনে করেন, আমেরিকা বৃহৎ শক্তির অংশ। তবে ভারতও কারও চাইতে কম যায় না। তিনি বলেন, ভারত তো গণতন্ত্রের বাইরে কথা বলেনি, কাজেই এটা নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তিত হওয়ার কী আছে? যারা নির্বাচন ছাড়া অন্য খেলা খেলে, তাদের কথা আমরা বরং সন্দেহের চোখে দেখব।
মতিয়া চৌধুরী বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ভারত নিয়ে এই মুহূর্তে সন্দেহের কোনো কারণ দেখছেন না তিনি। মতিয়া বলেন, অনর্থক উদ্বিগ্ন বা বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। বা এতে বাড়তি উৎফুল্ল হওয়ারও কোনো কারণ দেখি না।
আওয়ামী লীগের এই নেত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এই বাস্তবতা কেউ অস্বীকার করবে না, ভারতও নয়। আমরাও এটা মাথায় রাখব যে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। কোনো কিছুই দেশের স্বার্থের বাইরে বা ঊর্ধ্বে নয় এবং দেশের মানুষকে বাদ দিয়েও নয়।
‘ভারত ছাড়া সম্ভব নয়’
নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ায় ও বিভিন্ন স্বার্থের জন্য বাংলাদেশের ক্ষমতায় কারা আছে সেটি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মনে করা হয়, জাতীয় নিরাপত্তা, এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা এবং ভূরাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের চিন্তা-ভাবনা ও কৌশল থাকা স্বাভাবিক।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, নিকটতম প্রতিবেশী ও বিভিন্ন কারণে ভারতের জন্য বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটা বাস্তব যে বাংলাদেশের রাজনীতির বিষয়ে ভারতের স্বার্থ থাকতেই পারে। কারণ তারা নিকটতম প্রতিবেশী। আমাদের তিন দিকেই ভারত বেষ্টিত। সেখানে ভারত চাইবেই- বাংলাদেশে যারা ক্ষমতায় আছে তাদের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক থাকুক।
চুন্নু বলেন, সীমান্তের বিষয় আছে, আইনশৃঙ্খলার বিষয় আছে এবং কৌশলগত বিষয় আছে। এসব বিষয় নিয়ে ভারতের যেমন স্বার্থ আছে, বাংলাদেশেরও স্বার্থ আছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভারত তার নিজস্ব রাজনীতি এবং কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের বিষয়ে চিন্তা করতে পারে।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ভারতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগের বিষয়টি গোপন কিছু নয়। দলগুলোর প্রতিনিধি পর্যায়ে কিংবা দ্বিপাক্ষিক উচ্চ পর্যায়ের সফরগুলোতেও দলীয় প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকও হয়ে থাকে। সেই হিসেবেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ভারত সফর করেছেন।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মনে করেন, ভারতকে শত্রু ভেবে বাংলাদেশে রাজনীতি করা যাবে না। এভাবে ক্ষমতায়ও থাকা সম্ভব নয়। এর দুটি কারণ (রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক) দেখিয়ে তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিল যে তারা পেঁয়াজের ওপর ট্যাক্স বসাবে। এরপরই দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। এমনকিছু বিষয়ের কারণে আমরা প্রতিবেশী দেশের কাছে নির্ভরশীল হয়ে যাই। সূত্র: বিবিসি বাংলা