ভাষণের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের লাখো লাখো শহীদ এবং জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র, শ্রমিক, জনতার অভ্যুত্থানে নিহত সব শহীদকে সশ্রদ্ধ সালাম ও গভীর শ্রদ্ধা জানান প্রধান উপদেষ্টা। একই সঙ্গে স্মরণ করেন ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যারা আহত হয়েছেন, যারা ৯ দফা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং যারা দেশকে স্বৈরাচারের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তাদের।
ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি। আর তা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে।
ড. ইউনুস বলেন, কেবল জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডই নয়, আমরা গত ১৫ বছরে সব অপকর্মের বিচার করব। অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছে, খুন হয়েছে এই সময়ে। আমরা গুমের তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেছি। কমিশন প্রধান আমাকে জানিয়েছেন অক্টোবর পর্যন্ত তারা ১৬০০ গুমের তথ্য পেয়েছেন। তাদের ধারণা এই সংখ্যা ৩৫০০ ছাড়িয়ে যাবে।
গুমের শিকার ব্যক্তি ও পরিবারকে নিরাপত্তা ও বিচারের বিষয়ে আশ্বস্ত করে ড. ইউনূস বলেন, অনেকেই কমিশনের কাছে গুমের অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন এই ভেবে যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা তারা আবার আক্রান্ত হতে পারেন, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আপনারা দ্বিধাহীন চিত্তে কমিশনকে আপনাদের অভিযোগ জানান। কারো সাধ্য নেই আপনাদের গায়ে আবার হাত দেয়।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কোনো সদস্য কিংবা অন্য কেউ যাতে হত্যা, গুমসহ এ ধরনের কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে না পারে এজন্য আমরা গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সাক্ষর করেছি। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন।
তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘ জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের তদন্তে আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তারা আমাদেরকে তাদের রিপোর্ট হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
জুলাই গণহত্যা ও গুম-খুনের বিচার হবে আন্তর্জাতিক আদালতেও
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত প্রতিটি হত্যার বিচার করা হবে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত কাজ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বিচারের আওতায় পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকেও ভারত থেকে ফেরত চাওয়া হবে।
তিনি বলেন, দেশে বিগত ১৫ বছরে সংঘটিত প্রত্যেকটি গুম, খুন ও সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় জড়িতদের আন্তর্জাতিক আদালতেও বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের প্রধান কৌশলী করিম খানের সঙ্গে ইতোমধ্যে কথা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গুম কমিশনের সদস্যদের কাছে ভুক্তভোগীদের যে বিবরণ আমরা পেয়েছি তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের পর ছাত্র-ছাত্রীরা শহর বন্দরের দেয়ালে-দেয়ালে তাদের মনের কথা লিখেছে। তাদের আগে যারা গুমের শিকার হয়েছেন, প্রতিটি গোপন আস্তানার দেয়ালে-দেয়ালে তারা লিখে রেখেছেন তাদের কষ্টের মর্মস্পর্শী বিবরণ। তাদের এসব কষ্টের কথা শুনে আমাদের হৃদয় কেঁপে উঠেছে। এসবের সঙ্গে জড়িতদের আমরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবই। অভিযুক্ত যতই শক্তিশালী হোক, যে বাহিনীরই হোক তাকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে নির্বাচনের রোডম্যাপ
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেল লাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি আর তা হবে রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্যমত্যের মাধ্যমে।
ইউনূস বলেন, আমরা এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারি যা যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করা হবে। এর ফলে রাজনৈতিক সংকট থেকে আমাদের দেশ রক্ষা পাবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু আমি আপনাদের কাছে চেয়ে নিচ্ছি। নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপও পেয়ে যাবেন।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি না যে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিলেই নির্বাচন আয়োজনে আমাদের দায়িত্ব শেষ। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কার আমাদের এই সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। আপনারাই আমাদেরকে এই ম্যান্ডেট দিয়েছেন। যে ছয়টি সংস্কার কমিশন আমরা শুরুতে গঠন করেছিলাম তারা ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আপনারা তাদের কার্যক্রমের আপডেটও দেখছেন। কয়েকটি সংস্কার কমিশন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছে। আমার অনুরোধ আপনারা এই প্ল্যাটফর্মে উৎসাহ সহকারে আপনাদের মতামত জানাতে থাকুন।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কবে হবে, এই প্রশ্ন আপনাদের সবার মনেই আছে। আমাদের মনেও সারাক্ষণ আছে। নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছি। কয়েকদিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে যাবে। তারপর থেকে নির্বাচন আয়োজন করার সমস্ত দায়িত্ব তাদের উপর বর্তাবে।
ড. ইউনূস বলেন, আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, আপনারা সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার কাজ শেষ করেই আমরা আপনাদের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করব। ততোদিন পর্যন্ত আমি আপনাদের ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ করব।
পুলিশ বাধ্য হয়ে গণহত্যায় অংশ নিয়েছে
পতিত স্বৈরাচার পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাধ্য হয়ে পুলিশের অনেককেই গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন। খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা জনরোষের শিকার হয়েছেন। এতে তাদের মনোবল অনেক কমে যায়। আমরা পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে এনে তাদের আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। এ ক্ষেত্রে অনেক দৃশ্যমান উন্নতিও হয়েছে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে কিছু নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতিতে সহায়তা করেছে। এজন্য সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই। কঠিন এই সময়ে আপনারা সবাই অপরিসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। ধন্যবাদ জানাই দেশের রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে। তারা তাদের কর্মীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদী শক্তি ভয় দেখিয়েছিল তারা ক্ষমতা ছাড়লে দেশে লাখ লাখ লোক মারা পড়বে। টানা সাত দিন পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকার পরও ব্যাপক আকারে সহিংসতা এড়ানো গেছে।
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন প্রবাসীরা
ড. ইউনূস বলেন, নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ আরও কিছু কাজ শুরু করে দিতে পারবে যা একটি অবাধ নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে যাতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেই লক্ষ্যেও সরকার কাজ করছে।
তিনি বলেন, প্রথম ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে একটি হলো নির্বাচন সংস্কার কমিশন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এই কমিশনের সুপারিশমালা অত্যন্ত জরুরি। তাদের প্ল্যাটফর্মে যান। আপনার মতামত খোলাখুলিভাবে তুলে ধরুন। আপনি দেশের মালিক। আপনি বলে দিন আপনি কী চান। কীভাবে চান।
মন খুলে সংস্কারের পক্ষে মতামত দিন
প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে বলেন, নির্বাচন নিয়ে আপনাদের সব বক্তব্য বিনা দ্বিধায় বলতে থাকুন। সবার মনের কথা তুলে ধরুন। আমার অনুরোধ সংস্কারের কথাটাও একই সঙ্গে বলুন। সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে যাবেন না। নির্বাচনের কথা বলার সঙ্গে নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের কথাটিও বলুন।
সংস্কার হলো জাতির দীর্ঘমেয়াদি জীবনী শক্তি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংস্কার জাতিকে বিশেষ করে আমাদের তরুণ-তরুণীদের নতুন পৃথিবী সৃষ্টির সুযোগ দেবে। জাতিকে বঞ্চিত করবেন না।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন আয়োজনে সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় রাজনৈতিক দলগুলো এবং দেশের সব মানুষের মতামত অপরিহার্য। কমিশন হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই সুপারিশমালার কোন অংশ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তার ভিত্তিতে নির্বাচনী আইন সংশোধন করতে হবে। সমান্তরালভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া চলতে থাকবে।
সরকারকে ব্যর্থ করতে পতিত হাসিনার মহাপরিকল্পনা চলছে
ড. ইউনূস বলেন, এ সরকারকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করতে বিশাল অর্থে বিশ্বব্যাপী এবং দেশের প্রতিটি স্থানে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এক মহাপরিকল্পনা প্রতি মুহূর্তে কার্যকর রয়েছে। তাদের একটি বড় প্রচেষ্টা হচ্ছে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা।
তিনি বলেন, পতিত সরকারের নেতারা পাচার হওয়া অর্থ বিনিয়োগ করে তারা দেশে ফিরে আসার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদেরকে কিছুতেই সফল হতে দেবেন না। তারা সফল হওয়া মানে জাতির মৃত্যু। জাতি হিসেবে আমাদের অবসান। সাবধান থাকুন। তাদের সব হীন প্রচেষ্টাকে আমাদের ঐক্যের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিন। যে ভাবে নস্যাৎ করেছিলেন তাদের বন্দুকের গুলিকে, আয়না ঘরকে, অনাচারের শিকলকে। এ ব্যাপারে সবাই একমত থাকুন, ঐক্যবদ্ধ থাকুন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের সরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী। আমার দপ্তরসহ সব মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছি তাদের নিজ নিজ কাজের বিস্তারিত বিবরণ নিজেদের ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য।
দিল্লী থেকে দেখা করতে আসবেন ২০ দেশের রাষ্ট্রদূত
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২০ দেশের ২০ জন রাষ্ট্রদূত দিল্লিতে থাকেন। সাত দেশের সাত রাষ্ট্রদূত ঢাকায় আছেন। দিল্লি থেকে একসঙ্গে ২০ জন রাষ্ট্রদূতসহ মোট ২৭ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত সমবেতভাবে আমার সঙ্গে বৈঠক করার জন্য আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকায় আসছেন বলে জানান ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, কখনো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭ জন রাষ্ট্রদূত একত্রিত হয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেনি। দিল্লি থেকে এ বিশাল সংখ্যক রাষ্ট্রদূত একসঙ্গে বৈঠক করার জন্য আসেনি।
বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের এই সংকটময় সময়ে তারা প্রায় সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নেপাল, মালদ্বীপ, পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী বেশ কয়েকটি দেশের সরকার প্রধানের সঙ্গেও আমার বৈঠক হয়েছে যেখানে আমি সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলেছি।
২ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করেছি
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা যখন কাজ শুরু করেছি, দেশের অর্থনীতি ছিল বিপর্যস্ত। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে। আশার কথা এই রিজার্ভ পরিস্থিতি এখন উন্নতির পথে।
তিনি বলেন, গত তিন মাসে রিজার্ভে কোনোরকম হাত না দিয়েই আমরা প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে পেরেছি। জ্বালানি তেল আমদানিতে পুঞ্জীভূত বকেয়ার পরিমাণ ৪৭৮ মিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ১৬০ মিলিয়ন ডলারে আনতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ইতোমধ্যে ঋণ ও অনুদান হিসেবে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা আমাদের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সচল করতে সক্ষম হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পতিত সরকার আমাদের জন্য যে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি রেখে গিয়েছে তাতে রাজস্ব আদায়ে গতি আনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে। এর মধ্যেও জুলাইয়ের নেতিবাচক অবস্থা থেকে অক্টোবর নাগাদ রাজস্ব আদায়ে পৌনে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আগের অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বিপুল রাজস্ব ঘাটতি ছিল। যে কারণে এবার শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। এর ফলে স্বৈরাচার পতনের পরবর্তী তিন মাসে পৌনে ৯ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধির পরও লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২৩ শতাংশের বেশি ঘাটতি থেকে যায়। রাজস্ব আদায়ে গতি আনতে আমি এখন অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে উৎসাহিত করছি।
তিনি বলেন, একশ দিনে অর্থনীতি সবল অবস্থানে চলে এসেছে। এটা সম্পূর্ণ নিজস্ব নীতিমালা দিয়ে হয়েছে। বলা বাহুল্য এখনো আমাদের বন্ধুদের কাছ থেকে যে সাহায্যের আয়োজন হয়েছে, তা আসা শুরু করেনি। বন্ধু রাষ্ট্রগুলো শুধু যে আমাদের বড় বড় অঙ্কের সাহায্য নিয়ে আসছে তাই নয়, তারা এই সাহায্য দ্রুততম সময়ে আসা শুরু করবে এই প্রতিশ্রুতিও আমাকে দিয়েছে। এই সাহায্য আসা শুরু করলে আমাদের অর্থনীতি অত্যন্ত মজবুত এবং আকর্ষণীয় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও নানারকম বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে আসবে।
বড় ধরনের সহিসংতা ছাড়াই গার্মেন্টসের অস্থিরতা নিরসন
ড. ইউনূস বলেছেন, আমাদের বৃহৎ রপ্তানি পণ্য গার্মেন্টস শিল্পে গত কিছু দিন ব্যাপক অস্থিরতা বিরাজ করেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী বেশ কিছু গার্মেন্টস মালিক পালিয়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, অন্য অনেক কারখানায়ও শ্রমিকরা ন্যায্য বেতনসহ অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। শ্রমিকরা তাদের দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার প্রতিবাদ জানাতে এবং অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে রাস্তায় নেমে আসে। আমরা তাদের কথা শুনেছি, তাদের আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, মালিক-শ্রমিকের মধ্যে ১৮ দফার একটি ব্যাপকভিত্তিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বড় ধরনের কোনো সহিংসতা ছাড়াই আমরা শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন করতে পেরেছি। তারা আবার উৎপাদনে ফিরেছে। এতে প্রাণ ফিরে পেয়েছে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখি এই শিল্পও। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অক্টোবর মাসে আমাদের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ।
গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। একজনও বাদ যাবে না। সকল আহত শিক্ষার্থী শ্রমিক জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে। আহতদের দীর্ঘমেয়াদি এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসা এবং শহিদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতিটি শহীদ পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে। যারা বুলেটের আঘাতে তাদের দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন তাদের চিকিৎসার জন্য নেপাল থেকে কর্নিয়া আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাদের প্রয়োজন তাদের সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানের কোনো শহীদ এবং আহত ছাত্র-শ্রমিক চিকিৎসা সেবা এবং পুনর্বাসন পরিকল্পনা থেকে বাদ যাবে না। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অঙ্গীকার।
ড. ইউনূস বলেন, এই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে গঠিত ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ বেশ পাকাপোক্তভাবে তাদের কাজ শুরু করেছে। এই ফাউন্ডেশনে সরকার ১০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। এছাড়াও জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের সর্বোত্তম চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি বরাদ্দ প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছে
আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশকে ব্যবহার করেছে উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পতিত স্বৈরাচার পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছে। বাধ্য হয়ে তাদের অনেকেই গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন। খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা জনরোষের শিকার হয়েছেন। এতে তাদের মনোবল অনেক কমে যায়। আমরা পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে এনে তাদের আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, কঠিন সময়ে আপনারা সবাই অপরিসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। ধন্যবাদ জানাই দেশের রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে। তারা তাদের কর্মীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিশোধ স্পৃহায় লিপ্ত হয়ে কেউ যাতে হানাহানিতে জড়িয়ে না পড়ে সেই আহ্বান জানিয়েছেন। আপনাদের এই আহ্বানে সবাই সাড়া দিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ফ্যাসিবাদী শক্তি ভয় দেখিয়েছিল তারা ক্ষমতা ছাড়লে দেশে লাখ লাখ লোক মারা পড়বে। টানা সাত দিন পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকার পরও ব্যাপক আকারে সহিংসতা এড়ানো গেছে।
ড. ইউনূস বলেন, আমরা যখন দায়িত্ব গ্রহণ করি, বাংলাদেশ তখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত একটা দেশ। এসময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে অহেতুক আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে তারা সহিংসতারও শিকার হয়েছেন। কিন্তু এটা নিয়ে যেসব প্রচার-প্রচারণা হয়েছে তা ছিল সম্পূর্ণ অতিরঞ্জিত। অল্প যেসমস্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। আপনাদের সবার সহযোগিতায় আমরা দৃঢ়ভাবে এ পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি।