মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আজ নিরাপত্তা সংলাপে বসছে বাংলাদেশ। সম্পূর্ণ ভিন্ন ফরমেটে অনুষ্ঠেয় ওই সংলাপের মুখ্য আলোচ্য হবে বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি। ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে- অল্টারনেটিভ ভেন্যুতে (একবার ঢাকায়, অন্যবার ওয়াশিংটনে) ২০১২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মহাপরিচালক পর্যায়ে নিরাপত্তা সংলাপ হয়ে আসছে, এ পর্যন্ত ৭ দফা বৈঠকটি হয়েছে। এবারই প্রথম তা পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নিরাপত্তা সংলাপটি সচিব পর্যায়ে উন্নীতকরণে যুক্তরাষ্ট্রই আগ্রহী হয় বলে দাবি সেগুনবাগিচার।
তবে ফরমেট যাইহোক আলোচনায় খুব একটা নতুনত্ব থাকছে বলে মনে করেন না সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ৮ম ওই সংলাপে অতীতের আলোচনার ধারাবাহিতার পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও রাশিয়ার প্রভাব-বলয় বৃদ্ধি নিয়ে মার্কিন উদ্বেগের মতো স্পর্শকাতর বিষয়াদি আসতে পারে। ইউক্রেন সঙ্কট প্রশ্নে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়েও কথা হতে পারে। চীনের ড্রিম প্রজেক্ট বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা এবং রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জামাদি ক্রয়ের চিন্তায় যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তির বিষয়টি এখন অনেকটাই ওপেন-সিক্রেট।
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের সরব উপস্থিতিতে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র
নাতিদীর্ঘ ওই গোলটেবিল আলোচনায় বাংলাদেশ বিষয়ক প্রশ্ন ছিল মুশফিক আনসারীর। এডমিরাল স্যামুয়েল পেপেরোর উদ্দেশ্যে প্রশ্নকর্তা বলেন, বাংলাদেশে বন্দর তৈরি ও মেরামত এবং ইকোনমিক করিডোরের নামে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করছে চীন। প্রস্তাবিত করিডোরে চীনের সমৃদ্ধ প্রদেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বাড়বে। তাছাড়া বাংলাদেশ চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমরাস্ত্রের বাজার। বাংলাদেশের সরকারে জনগণের আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন নেই। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতাসীনরা (আওয়ামী লীগ) নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। যার অংশ হিসেবে তারা এখন ভারতকে (পুরনো মিত্র) পাশ কাটিয়ে চীনের সঙ্গে সখ্যতা বাড়াচ্ছে। চীনের ওপর বাংলাদেশের অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার বিষয়ে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এডমিরাল পেপেরো বলেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা স্ট্রিং অব পার্লস- যেভাবেই দেখি না কেন বন্দর এবং উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে ভারত মহাসাগরে চীনের তৎপরতার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক।
একইভাবে আমরা সচেতন রয়েছি বিভিন্ন দেশে চীনা ঋণের ফাঁদ নিয়েও। সেই ফাঁদের পরিণতিতে বিশেষ অভিযানসহ নানা ঘটনা ঘটার শঙ্কা থাকে। ভূ-রাজনীতিতে ভারত মহাসাগরের ভূমিকা সম্পর্কে ওই সামরিক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ব-বাণিজ্যের অন্যতম মূল কেন্দ্র হিসেবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাণিজ্য, সংস্কৃতি লেনদেন এবং মানুষের নির্বিঘ্ন চলাচল জরুরি। এ অঞ্চলে চীনের উদ্যোগ বিষয়ে আমরা সদা-সতর্ক। যেমনটি আমরা হামবানতোতা, গাওয়ার এবং জিবুতিতে তাদের কার্যক্রমে নজর রাখেছি, এসব এলাকায় তাদের তৎপরতা আমাদের শঙ্কিত করে। গোলটেবিল বৈঠকে এডিমিরাল পেপেরো বলেন, এসব সত্ত্বেও সম্প্রতি সম্মিলিত বাহিনীর মেরিটাইম কম্পোনেন্ট কোর্সে রিয়ার এডমিরাল ইকবালের কোম্পানি উপভোগ করার পর, আমি বাংলাদেশ এবং মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিককে সমর্থনকারী দেশগুলোর জোটের মধ্যে গভীর অংশীদারিত্বের পথ দেখতে পাচ্ছি। আমরা সকলে অবাধ এবং উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের মূল্যবোধে বিশ্বাস করি। মিস্টার আনসারীর উদ্দেশ্য মার্কিন সামরিক ওই কর্মকর্তা বলেন, “আপনার কথাগুলো আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। আমরা বিশ্বাস করি এবং আশা করি আপনার এই ধারণার সঙ্গে বাংলাদেশের নেতৃত্বও একসময় সহমত পোষণ করবেন।”
নিরাপত্তা সহযোগিতা গ্রহণে ঢাকা উভয় সংকটে!
ফোর্সেস গোল-২০৩০ এর অধীনে নিরাপত্তা সক্ষমতা বাড়াতে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী উন্নত সমরাস্ত্র কিনতে আগ্রহী বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা প্রায়শই বলেন, সবচেয়ে ভালো সমরাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু দাম বেশি এবং জটিল সব শর্তের কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অনেক রাষ্ট্রের তা অ্যাফোর্ট করা কঠিন। অন্যদিকে উন্নত মানের তবে সাশ্রয়ী মূল্যে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারে রাশিয়া। কিন্তু ওই দেশের সমরযানে যে কোন ছুঁতোয় মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি রয়েছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অনেকটা উভয় সঙ্কটে রয়েছে ঢাকা। সেই সঙ্কট মাথায় নিয়ে আজ ওয়াশিংটনে নিরাপত্তা সংলাপে বসছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। দিনব্যাপী ওই প্রস্তাবিত বৈঠক বিষয়ে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্য ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে সচিব মাসুদ বিন মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংলাপে অনেক বিষয়েই কথা হবে। বিশেষত সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ এবং উগ্রপন্থা দমনে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার বিষয়ে আলোচনা হবে।
বিভিন্ন মহড়া ও প্রশিক্ষণ কীভাবে বাড়ানো যায় এবং কোস্ট গার্ডকে করা মার্কিন সহযোগিতার বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা হবে। একইসঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে এর সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলো নিয়েও কথা হবে। তিন সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত পার্টনারশিপ ডায়ালগ বা অংশীদারি সংলাপে নেতৃত্ব দিতে ঢাকায় ৩ দিন কাটিয়ে গেছেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। তার সফরে বহুল আলোচিত সামরিক চুক্তি জিসোমিয়ার খসড়া হস্তান্তর করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, খসড়াটি বাংলাদেশ যাচাই-বাছাই করছে। এ নিয়ে আরও আলোচনা হবে জানিয়ে সচিব বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সামরিক ক্রয় বিষয় প্রস্তাবিত মার্কিন চুক্তির কোনো ধারা সাংঘর্ষিক কিনা তা নিশ্চিত হতে চুক্তি সইয়ে আরো কিছুটা সময় নিবে বাংলাদেশ। সচিব জানান, র্যাবের ওপর বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা পূনর্বিবেচনার অনুরোধ পুনর্ব্যক্ত করা হবে। ৬ই এপ্রিলের বৈঠকে ইউক্রেন ইস্যুতে কথা হতে পারে জানিয়ে সচিব বলেন, আমাদের যে নীতিগত অবস্থান সেটির ওপর ভিত্তি করে আমরা কথা বলবো। বর্তমান মেরুকরণের বিশ্বে আমাদেরকে পথ বের করতে হবে যেখানে আমরা সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলতে পারি। ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ আছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা তাদের কথা শুনবো, এ নিয়ে বিশেষ কোনো অনুরোধ থাকলে দেশে ফিরে অন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে অনুরোধ রক্ষা, প্রত্যাখ্যান কিংবা সমন্বয় করবো।