পরিবারের এক সদস্যের চিকিৎসার জন্য বাধ্য হয়েই সপ্তাহে এক হাজার টাকা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন বাবুল। সেই ঋণের আসল শোধ হয়ে গেলেও মহাজনের সুদের বোঝা শেষ হয়নি এখনও। উল্টো সুদের টাকা শোধ না করায় মহাজনের আঘাতের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন বাবুল গাজী।
একই এলাকার পিঠাবিক্রেতা রহিমা বেগম। তিনিও এমন চড়া সুদে ঋণ নিয়েছিলেন। আসলের টাকা শোধ হলেও সুদের টাকা শোধ করতে মহাজনের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছেন প্রায় এক বছর। আর রানী বেগম সুদের টাকা শোধ করতে বিক্রি করেছিলেন তার গর্ভের সন্তান।
বাবুল গাজী, রহিমা বেগম ও রানী বেগমের মতো ওই এলাকার কয়েকশ শ্রমিক ও দিনমজুর মহাজনের সুদের ফাঁদে এমনভাবে জড়িয়েছেন যেন মুক্তির কোনো পথ নেই। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এমন মহাজনী প্রথা এখনও সমাজে রয়েছে এবং আমাদের আশপাশেই। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পাগলা এলাকায় ঋণের টাকার সুদ পরিশোধ করতে সদ্য নবজাতক বিক্রির ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পরই এমন অনেক ঘটনাই সামনে আসছে।
ঘটনার শুরু যেভাবে
নারায়ণগঞ্জের পাগলা আলীগঞ্জ এলাকায় পিডব্লিউডি কলোনির বেশ পরিচিত নাম লাকী বেগম। স্থানীয়দের কাছে যিনি পরিচিত ‘জল্লাদ লাকী’ হিসেবে। তার প্রধান ব্যবসা টাকা ধার দিয়ে সুদ আদায় করা। দুই বছর আগে লাকী বেগমের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন দিনমজুর রানী আক্তারের স্বামী নির্মাণশ্রমিক হান্নান চৌকিদার। রানী আক্তার নিজেও কাজ করেন একটি ইটভাটায়। ঋণের শর্ত ছিল পাঁচ হাজার টাকায় সপ্তাহে এক হাজার টাকা সুদ দিতে হবে। অর্থাৎ মাসে সুদের পরিমাণ হবে চার হাজার টাকা। আর তাতেই সুদের জালে আটকা পড়েন দরিদ্র দম্পতি।
এক বছরে সুদের টাকা পরিশোধ করা নিয়ে বেশ কয়েকবার মহাজন লাকী বেগম ও তার লোকজনের হাতে মার খেতে হয়েছে হান্নানকে। একপর্যায়ে তিনি এ ঋণের ভয়ে গর্ভবতী স্ত্রী রানীকে রেখেই পালিয়ে যান। স্বামীর ঋণ আর সুদের বোঝা বইতে বইতে সেই আসল পাঁচ হাজারের সুদ এক লাখ ৬০ হাজার টাকা শোধও করেছেন লাকী। কিন্তু মাফ মেলেনি মহাজনের। শেষপর্যন্ত এক বছর আগে রানীর নবজাতককে বিক্রি করে দেন লাকী বেগম। এ শিশু বিক্রির জন্য ক্রেতা ঠিক করা থেকে শুরু করে সব ব্যবস্থা করেছেন মহাজন লাকী বেগম। কিন্তু এক বছর পর সেই সুদের জন্য আবারও চাপ দিতে থাকায় এবার সাহস করে থানায় অভিযোগ করেন রানী। প্রকাশ পায় সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে নিজের নবজাতক সন্তান বিক্রির বিষয়টি।
পুলিশ সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে গত ১৭ এপ্রিল মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর এলাকা থেকে রানীর সেই বিক্রি করে দেওয়া সন্তানকে উদ্ধার করে। গ্রেপ্তার করা হয় সুদের কারবারি লাকী ওরফে জল্লাদ লাকীসহ দুজনকে। এলাকায় গিয়ে বিষয়টি খোঁজ নিলে বেরিয়ে আসে সুদের মহাজনী প্রথার নানা ভয়ংকর চিত্র।
সুদের চক্রে পুরো পরিবার
আলীগঞ্জ পিডব্লিউডি কলোনির বাসিন্দা বলতে মূলত দিনমজুর, রিকশাচালকসহ নিম্ন আয়ের লোকজন। কেউ থাকেন পরিবার নিয়ে, কেউ থাকেন কয়েকজন মিলে। এ কলোনিতেই গত ছয় বছর ধরে সুদের ব্যবসা খুলে বসেছেন লাকী বেগম। তার শেল্টারদাতা হলেন বাবা মোহাম্মদ আজাদ ও স্বামী হজরত আলী। তারা দুজন সরকারি চাকরি করেন। তাই ভয়ে কেউ কিছু বলেন না। মোহাম্মদ আজাদ নিজেই গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন, তিনি সোহরাওয়ার্দী স্মৃতি মিলনায়তনের পাহারাদার আর মেয়ের জামাই হজরত আলী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন।
কলোনির বাসিন্দারা জানান, আজাদের মেয়ে লাকী বেগম সুদের ব্যবসা করেন। স্বামী হজরত আলী এলাকায় বহু বছর ধরে জুয়ার বোর্ড চালাচ্ছেন। দিনমজুরদের টাকা লুটে নেওয়ার নেপথ্যে এ জুয়ার বোর্ড দায়ী বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এলাকার নারীরা।
তারা জানান, লাকী বেগম বেছে বেছে এমন লোকদের ঋণ দেন যারা তার স্বামীর জুয়ার বোর্ডে জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। ঋণ শোধ করতে না পারলে মারধরের শিকার হওয়া ছাড়াও মামলার আসামি পর্যন্ত হতে হয়। জোর করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয় ঋণগ্রহীতাদের। দিনমজুর হতদরিদ্র এসব মানুষ এ সুদ আর জুয়ার চক্রে পড়ে অন্যায়ের শিকার হয়েও অভিযোগ দেওয়ার সাহস পান না।
অঝোরে কাঁদলেন সেই ধাত্রী
ষাটোর্ধ্ব অভিজ্ঞ ধাত্রী রাবিয়া বেগম। কলোনির দরিদ্র নারীদের কাছে তিনি খুবই সম্মানিত। এক বছর আগে রানী বেগমের বিক্রি হওয়া সেই শিশুটি ভূমিষ্ট হয়েছিল রাবিয়ার হাতেই। তিনি বলেন, ‘বাচ্চাটা আমার হাতেই জন্ম নিছিল। রানীর জামাই (স্বামী) ওরে ছাইড়া গেছিল বাচ্চাটা পেটে থাকতেই। বাচ্চাটা হওয়ার তিন দিনের মাথায় রানী আইছিল আমার ঘরে। আমি কইলাম এ অবস্থায় তুই কেন আইলি। আমারে ৫০০ টাকা দিতে চাইল, কিন্তু আমি নেই নাই। কইলাম, তুই নিজেই তো চলতে পারোস না, তর পোলা কই রাইখা আইছোস। কইতেই রানী আমারে ধইরা চিক্কর (চিৎকার) দিয়া কানতাছিল আর কইল, খালাগো পোলাডা ভোর বেলা জন্মাইছে আর বিকালেই বেইচ্ছা দিছে লাকী।’
রাবিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় কয়েকজন বাসিন্দা সেই কথার সাক্ষী হন। তারা বলেন, ‘হ, ২৪ ঘণ্টা না যাইতেই লাকী ওর পোলারে বেইচ্চা দিছে। যে মহিলা বাচ্চাডা কিনছে সে পুরা টেকাডা রানীর হাতে দিছিল। কিন্তু লগে লগেই লাকী ওই টাকা কাইড়া নিছে। পরে কোনো টেকা দিছে কিনা জানি না।’
বুকের ধন ফিরে পেয়ে খুশি রানী
নিজের বাচ্চা বিক্রির পর থেকে সুদখোর লাকীর বাসাতেই ঝিয়ের কাজ করতেন রানী বেগম। কারণ, কাজের বিনিময়ে হলেও সুদের টাকা কিছু কিছু করে পরিশোধ করা। ভাগ্য বদলের আশায় বছর চারেক আগে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বাদুরতলা থেকে স্বামীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ এসেছিলেন রানী। ইট ভাঙার শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। তারপর থেকে কলোনির সুদের মহাজন আজাদের বাড়িতেই ভাড়া থাকেন তারা। আজাদের ছোট মেয়ে লাকী বেগমের কাছ থেকেই ঋণ নিয়েছিলেন রানীর স্বামী হান্নান।
রানী বেগম বলেন, ‘গর্ভে সন্তান আসার পর ওরে পেটে নিয়াই কাজ করছি। সেই সন্তান যখন জন্ম নিল তখন আমারে না জানাইয়া এক দিনের ছেলেরে বেইচা দিছিল। কোথায়, কার কাছে বিক্রি করসে আমি তা জানতাম না। আমি যখন ছেলে বেচার কারণ জানতে চাইলাম তখন লাকী বলল, সুদের টেকা না দেওয়ায় ছেলেটারে বেইচা দিসে। তাছাড়া বাচ্চা থাকলে আমার কাজ করতে সমস্যা। ঠিকঠাক কাজ না করা গেলে সুদের বাকি টাকা ফেরত দিতে সমস্যা হইব।’
‘ইট ভাঙা যে আয় হয়ছিল তা দিয়ে ঋণ শোধের চেষ্টা করছি। কিন্তু দিনের পর দিন ঋণ কেবল বাড়ছে। ইদানিং সুদের টাকার জন্য অতিরিক্ত চাপ দেওয়ায় শেষপর্যন্ত পুলিশের কাছে যাই।’
এ বিষয়ে ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাকিবুজ্জামান বলেন, এক বছর আগে সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় দিনমজুর রানী বেগমের এক দিনের নবজাতককে লাকী বেগম ৬৫ হাজার টাকায় মুন্সীগঞ্জে বিক্রি করে দেন। এ ঘটনায় রানী বেগমের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মুন্সীগঞ্জ থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করি এবং সুদের কারবারি লাকীকে গ্রেপ্তার করি। লাকী এক দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে— জানান তিনি।