নাটোর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকার যোগসাজশে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার অন্তঃসত্ত্বা ১৩২ নারীর কাছ থেকে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের জন্য মেডিকেল রিপোর্ট আনতে গিয়ে এ প্রতারণার শিকার হন তারা। এসব নারীর প্রত্যেকের প্রতি মাসে ১ হাজার ৫৫৫ টাকা করে ৩৬ মাস ভাতা পাওয়ার কথা।
বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়। কমিটি গত বৃহস্পতিবার (১ জুন)থেকে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে।
এবিষয়ে লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়ীয়া (ইউপি) চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান কালু জানান, ইতোমধ্যে ঘটনাটির সমাধান চেয়ে তার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগীরা। ঘটনাটি পরিষদের মাসিক সভায় আলোচনা করা হয়েছে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের দেওয়া মেডিকেল রিপোর্টের ভিত্তিতেই মাতৃত্বকালীন ভাতার কার্ডের আবেদন করা যায়। গরীব অসহায় দুঃস্থ গর্ভবতী নারীদের কাছ থেকে কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা সুইটি রানী ন্যাক্কারজনক কাজ করেছেন। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ করেন, মেডিকেল রিপোর্ট আনতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা সুইটি রানীর দারস্থ হন তারা। পরে সুইটি রানী তাদের পাঠিয়ে দেন ‘হেলথ কেয়ার’ নামে শহরের চকরামপুর এলাকার একটি ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারে। সেখানে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই আলট্রাসনোগ্রাফির পাশাপাশি একগাদা পরীক্ষা করিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয় গরীব অসহায়দের চার লক্ষাধিক টাকা।
সদর উপজেলার গাজীপুর বিল এলাকার গিয়ে কথা হয় সন্তানসম্ভাবা জরিনা খাতুন জানান, মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের আবেদনের প্রয়োজনে মেডিকেল রিপোর্টের জন্য কিছুদিন আগে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা সুইটি রানীর দ্বারস্থ হন তিনি। পরে সুইটি রানী তাকে পাঠিয়ে দেন ‘হেলথ কেয়ার’ নামে শহরের একটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে। সেখানে আলট্রাসনোগ্রাফির পাশাপাশি অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই একগাদা পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। এতে তাকে গুনতে হয় ১৬০০ টাকা।
আটঘরিয়া গ্রামের গৃহবধু শাহিদা জানান, বনপাড়ার জাহেদা হাসপাতাল থেকে তিনি আলট্রাসনোগ্রাফি করেন। সেই রিপোর্ট নিয়ে সুইটি রানীর কাছে গেলে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার আগের কাগজপত্র চলবে না বলে জানান সুইটি। পরে হেলথ কেয়ারে নানা পরীক্ষার মাধ্যমে ২৫০০ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
এ ইউনিয়নে ভুক্তভোগী সাথী, পাপিয়া, জেসমিন, আঁখি, লাইলি, আলেয়াসহ ১৩২ জন নারীর সাথে একই ঘটনা ঘটেছে। তারা ঘটনাটি সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানিয়েছেন।
সদর হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. পরিতোষ কুমার রায় জানান, একজন নারী সন্তানসম্ভাবা কিনা তা জানার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে এতো গুলো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র মুত্র পরীক্ষার মাধ্যমেই বিষয়টি জানা যায়। আলট্রাসনোগ্রাফি করা যেতে পারে।
এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া স্বাস্থ্য পরিক্ষা করারও কোনো বিধান নেই।
হেলথ কেয়ার ডায়াগনষ্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. ইসমাইল হুসাইন জানান, রোগীরা যে পরীক্ষা করতে বলেছে আমরা শুধু সেই পরীক্ষাগুলোই করেছি। সুইটি রানী স্বাস্থ্য সেক্টরে একজন সরকারী কর্মকর্তা। এই হিসাবে ওনার সাথে আমাদের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। তিনি অনেক পরিচিত মানুষকে আমাদের এখানে চিকিৎসার জন্য পাঠান।
অভিযুক্ত সুইটি রানী বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ মিথ্য ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমুলক। তিনি কাউকে হেলথ কেয়ার ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে পাঠাননি বলে অস্বীকার করেন।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোসাঃ মাহফুজা খানম জানান, মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের প্রয়োজনে মেডিকেল রিপোর্ট করাতে শতাধিক নারী সুইটি রানীর কাছে যায়। এসময় সুইটি রানী তাদের পাঠিয়ে দেন হেলথ কেয়ার নামে শহরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখানে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই আল্ট্রাসনোগ্রাফিসহ অপ্রয়োজনীয় একাধিক পরীক্ষা করে কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান খানকে সদস্য করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্ত কমিটির আহবায়ক জেলা পরিবার পরিবার পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের ক্লিনিক্যাল কনট্রাসেপসনের সহকারী পরিচালক আব্দুর রউফ মল্লিক জানান, কমিটি গত বৃহস্পতিবার (১ জুন) থেকে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে। তারই অংশ হিসাবে লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান কালুর উপস্থিতিতে তার কার্যালয়ে ৫ ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনদের সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তারপর তদন্ত কমিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা সুইটি রানীরও জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আগামী ১৩ জুনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।