ভালো বেতনে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে নাচের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণীকে দুবাই পাঠানো হতো। সেখানে পৌঁছানোর পর হোটেল ও ড্যান্সবারে মেয়েদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হতো। তাদের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের বিভিন্ন নাচের ক্লাব বা সংগঠন থেকে কাজ দেওয়ার নামে মেয়েদের দুবাই পাঠাতো। এ চক্রের ৩০ সদস্যের নাম এরইমধ্যে জবানবন্দিতে বলেছেন তিনজন ভিকটিম ও চারজন আসামি। কিন্তু অধিকাংশ আসামির ঠিকানা প্রকাশ করতে পারেননি তারা। তাছাড়াও দুবাইতে অবস্থানরত আসামিদের বিষয়ে তথ্য পাঠানোর জন্য একাধিক সংস্থায় চিঠি দেওয়া হলেও এখনও তথ্য পায়নি তদন্ত সংস্থা সিআইডি। তবে তদন্ত সংস্থা বলছে, মামলার তদন্ত শেষে পর্যায়ে। শিগগির আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।
২০২১ সালের ২ জুলাই মূলহোতা আজম খানসহ নয়জনের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে লালবাগ থানায় একটি মামলা করেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মৃণাল কান্তি শাহ। এ মামলার অভিযোগ ও তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদনে এসব কথা উল্লেখ করেছে তদন্ত সংস্থা সিআইডি। এ মামলায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন। তিনি বর্তমানে জামিনে। ইভান ছাড়াও এ মামলায় আরও সাতজন গ্রেফতার রয়েছেন।
বর্তমানে এ মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। মামলার অগ্রগতির বিষয়ে ৩০ অক্টোবর আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক বারেক করিম হাওলাদার। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, মামলার তিনজন ভিকটিম ও চারজন আসামি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তারা মোট ৩০ জনের মতো আসামির নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ আসামির ঠিকানা প্রকাশ করতে পারেননি।
তাছাড়াও মামলার ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট দুবাইতে অবস্থানরত আসামিদের বিষয়ে তথ্যের জন্য একাধিক সংস্থায় চিঠি পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ভিকটিম ও আসামির আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উল্লিখিত আসামিদের মধ্যে কয়েকজনের নাম ও ঠিকানা পাওয়া গেছে। তবে মামলাটি সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অন্য আসামিদের পূর্ণাঙ্গ নাম ও ঠিকানা সংগ্রহের কার্যক্রম চলমান। মামলার তদন্তকালে তদন্তের যাবতীয় কার্যক্রম সমাপ্ত হলেও মামলার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত দুবাইতে অবস্থানরত আসামিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ এবং আসামি ও ভিকটিমদের জবানবন্দিতে উল্লেখিত আসামিদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা সংগ্রহ মামলাটি তদন্তে বিলম্বের কারণ। এমতাবস্থায় মামলাটি তদন্তের অসমাপ্ত কার্যক্রম সমাপ্ত করে বিজ্ঞ আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অতিরিক্ত ৩০ (ত্রিশ) কার্যদিবস সময় মঞ্জুরের আবেদন করছি। আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনটি মঞ্জুর করেন।
‘আর্টিস্ট’ বলে তরুণীদের বিদেশে পাচার
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগকে গুলশান নিকেতন এলাকা থেকে ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের রিমান্ডে নেয়া হওয়। এরপর কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি জামিনে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইভান শাহরিয়ার সোহাগ আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য। নাচের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথা বলে তরুণীদের ‘আর্টিস্ট’ হিসেবে দেখিয়ে বিদেশে পাচার করতেন তিনি। ইভানদের মানবপাচারের জাল বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। তিনি ও তার চক্রে লোকেরা ভুক্তভোগীদের নাচ শিখিয়ে ভালো বেতনে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবে রাজি হলে ভুক্তভোগীদের থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করাসহ ক্লাবে নাচ-গান করার বিনিময়ে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন প্রদান করবেন বলে মৌখিক চুক্তি করেন তারা।
ভুক্তভোগীরা সরল বিশ্বাসে আসামিদের ওপর ভরসা করে দুবাইসহ অন্যান্য দেশে যেতে রাজি হন। আসামি আজম খান, তার ভাই নাজিম ও এরশাদের সহায়তায় ভুক্তভোগী ময়নার পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাজগপত্র প্রস্তুত করে দেন। তারপর ২০১৯ সালের মে মাসে ময়নাকে দুবাইয়ের শারজাহ নিয়ে যান। পরবর্তীকালে সেখানে নিয়ে ময়নাকে নিজেসহ বিভিন্ন লোক নিয়ে যৌন নির্যাতন চালান আজম খান। কিন্তু দুবাই গমনের পর আসামিরা ময়নাকে কোনো বেতন দেননি। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নির্মল দাস, আলমগীর, আমান ও শুভসহ অজ্ঞাতনামা এজেন্টের সহায়তায় ভুক্তভোগী আলেয়া ও মনি আক্তারদের ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গার ড্যান্স ক্লাব থেকে প্রলোভন দেখিয়ে বেছে নেন। এভাবে বহু বাংলাদেশি নারীর সরলতার সুযোগ নিয়ে আসামিরা দুবাইসহ অন্যান্য দেশে পাচার করেন এবং জোরপূর্বক আটক রেখে যৌন নির্যাতন চালান।
এ সংক্রান্ত মামলার এজাহারে বলা হয়, বিবাদী আলামিন হোসেন একজন ড্যান্স প্রশিক্ষক। ময়নাকে ডায়মন্ডের কাছে নিয়ে আসেন তার পরিচিত মিরপুরের ভুক্তভোগী ফাতেমা। ময়নাকে ডায়মন্ড আশ্বস্ত করেন যে, ভালো বেতনে তাকে বিদেশে নাচের ব্যবস্থা করে দেবেন। ডায়মন্ডের কথায় ময়না আশ্বস্ত হলে ২০১৯ সালের ২ মে আরেক আসামি স্বপন হোসেনের কাছে নিয়ে আসা হয়।
স্বপন দুবাইয়ের ড্যান্স ক্লাব ফরচুন পার্ল হোটেল, ফরচুন গ্রান্ড সিটি টাওয়ারের মালিক বিবাদী আজমের কাছে নিয়ে যান ময়নাকে। ময়নার থাকা-খাওয়া নিশ্চিতকরণসহ ক্লাবে নাচ-গান করার বিনিময়ে প্রতি মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে মর্মে মৌখিক চুক্তি করেন আজম। ময়না সরল বিশ্বাসে তার ওপর ভরসা করে দুবাই যেতে রাজি হন। আজমের ভাই আসামি নাজিম ও এরশাদের সহায়তায় ময়নার পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করা হয়। তারপর মে মাসে ময়নাকে দুবাইয়ের শারজাহ নিয়ে যান তারা। পরে আজম সেখানে নিয়ে ময়নাকে নিজেসহ বিভিন্ন লোক দিয়ে যৌন শোষণ ও নিপীড়ন করেন। কিন্তু দুবাই গমনের পর তারা ময়নাকে কোনো টাকা-পয়সা দেননি।
ঠিক একই কায়দায় আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে আসামি নির্মল দাস, আলমগীর, আমান ও শুভসহ অজ্ঞাতনামা এজেন্টদের সহায়তায় ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গার ড্যান্স ক্লাব থেকে প্রলোভন দেখিয়ে ভুক্তভোগী আলেয়া ও মনি আক্তারদের বেছে নেন এবং শিকার বানান।
এভাবে বহু বাংলাদেশি নারীর সরলতার সুযোগ নিয়ে দুবাইসহ অন্যান্য দেশে পাচার করেন এবং জোরপূর্বক আটক রেখে যৌন শোষণ ও নিপীড়ন করেন আসামিরা। তারা একটি সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য। দীর্ঘদিন ধরে অনুরূপভাবে বাংলাদেশি তরুণীদের দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন তারা।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক বারেক করিম হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। শিগগির আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।