ছোট ছোট প্লট, ছোট ছোট ঘর। চোখ আটকে যাবে সবুজের ভেতর লাল ইটের দেয়ালে। প্লটের সামনে ঝুলছে কারও কারও সাইনবোর্ড। পুরোনো চেনা ছবি এখন আর নেই। দখলবাজদের দাপটে এখন এপাশে বাঁকখালী নদী, অন্যপাশে প্যারাবন। ৬০০ হেক্টর প্যারাবনে দখলদারদের থাবা। বনের ভেতরে শুকিয়ে যাওয়া নদীর সাত কিলোমিটারজুড়ে পোলট্রি খামার, দোকানপাট, চাল-ময়দার মিল আর ঘরবাড়ি। দখলদারদের কেউ কেউ নদী-প্যারাবনের জমি নিজের বলে চালিয়ে বেচাকেনা চালাচ্ছেন দেদার। ইচ্ছা হলেই কেনা যায় নদী ও বনের বুকে প্লট। প্রতি প্লটের দাম পড়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ। সরকারি জমি বেচে দিয়ে কোটি কোটি টাকা পকেটে পুরে ফুলেফেঁপে উঠছে দখলবাজরা।
কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর আরও ৯ কিলোমিটার গভীরে চলছে দখলের আয়োজন। নদী আর বনে দিন দিন বাড়ছে দখলি স্থাপনা। দখলবাজদের তালিকায় উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতা, পৌর মেয়রসহ বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধির নামও। খোদ পৌর কর্তৃপক্ষ আবর্জনার ভাগাড় বানিয়েছে নদীকে। পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা এবং হাইকোর্টের নির্দেশনায়ও ঠেকানো যাচ্ছে না নদী ও বনের মরণ। দখলবাজদের চোখ রাঙানিতে যেন বাকরুদ্ধ বাঁকখালী, নির্বাক প্যারাবন।
পরিবেশবিদরা বলছেন, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড় থেকে সৃষ্ট বাঁকখালী নদী রামুর ওপর দিয়ে কক্সবাজার শহরের উত্তর পাশ হয়ে আঁকাবাঁকা পথে মিশেছে বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী চ্যানেলে। বাঁকখালীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৭ কিলোমিটার। সেই নদীর তীরে এক দশক আগে গড়ে তোলা হয় প্যারাবন (ম্যানগ্রোভ)। ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো সামুদ্রিক দুর্যোগ থেকে উপকূলকে বাঁচাতে এ বনাঞ্চল প্রহরী হয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে ভূমিখেকোদের গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে বন-নদী। ধ্বংস হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ও জীববৈচিত্র্য।
দখলের পেছনে ক্ষমতাসীনরা :জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর বাঁকখালী ও প্যারাবন দখলের সঙ্গে জড়িত ১৫৭ জনকে চিহ্নিত করে। অধিদপ্তর দখলের অভিযোগে মামলাও করেছে দুটি। মামলায় আসামি করা হয় কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এস এম আতিকুর রহমানের তিন ছেলে মিজানুর রহমান, এস এম কফিল উদ্দিন ও জসিম উদ্দিনকে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, কস্তুরাঘাট এলাকায় এ তিন ভাইয়ের নেতৃত্বে নদী দখল ও প্যারাবনের গাছ কাটা হচ্ছে। এ ছাড়া মামলায় কক্সবাজার জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি (সম্প্রতি বহিস্কৃত) ও খুরুস্কুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান সিদ্দিকী, তার ভাই খুরুস্কুল ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম সিদ্দিকী, তাদের স্বজন আদনান সাউদ, জসীম উদ্দীনের নামও রয়েছে। আসামি হিসেবে স্থানীয় প্রভাবশালী মো. সোহেল, আমিনুল ইসলাম আমান, মোহাম্মদ সেলিম ও ওমর ফারুকের নাম থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা। উল্টো তাদের দখলের বিস্তার আরও বাড়ছে।
দখলবাজ তালিকায় মেয়র : জেলা প্রশাসনের গঠিত নদী সংরক্ষণ কমিটির সদস্য কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান। সেই ‘নদী সংরক্ষক’ই করছেন নদীর সর্বনাশ। অভিযোগ রয়েছে, বাঁকখালী নদীর পাড় দখল করে মেয়রের নির্দেশে নির্মাণ করা হয়েছে বেশকিছু স্থাপনা। উচ্চ আদালতের নির্দেশ না মেনে মেয়রের আদেশেই নদীতে প্রতিদিন ফেলা হচ্ছে আবর্জনা। সম্প্রতি শহরের কস্তুরাঘাট, পেশকারপাড়া ও ননিয়ারচড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পৌরসভার ট্রাক দিয়ে নদীতে ফেলা হচ্ছে বর্জ্য।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দখলবাজদের তালিকায় পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানের নাম প্রথম ওঠে আসে। এক যুগ ধরে নতুন বাহারছড়া এলাকায় বাকখালী নদীর পাড় দখল করে বেশকিছু ছোট ঘর ও একটি ওয়্যারহাউস নির্মাণ করেন আওয়ামী লীগের এই নেতা। বিআইডব্লিউটিএ ও পৌরসভার কর্মকর্তা এবং স্থানীয়রা জানান, ছোট ঘরগুলো ও ওয়্যারহাউসটি ভাড়া দিয়েছেন মুজিবুর। সর্বশেষ ২০২০ সালের বিআইডব্লিউটিএর ১৩০ জনের দখলবাজদের নতুন তালিকায়ও ছিল মেয়র মুজিবুরের নাম। পাশাপাশি ওই তালিকায় ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাশেদুল হক রাশেদও।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা রিটের ভিত্তিতে নদী দখলদারদের তালিকা প্রকাশ করতে কক্সবাজার প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একইভাবে সংশ্নিষ্ট কর্তৃৃপক্ষকে জরিপ করে দখল হওয়া ভূমি পুনরুদ্ধার করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। এ ছাড়া দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতেও হাইকোর্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
এদিকে ২০১৫ সালে ৯২ নদী দখলবাজদের একটি তালিকা প্রকাশ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। ২০১৪ সালের তালিকায় নাম থাকলেও অদৃশ্য কারণে ২০১৫ সালের কাগজপত্র থেকে হারিয়ে যায় মুজিবুরের নাম। ওই তালিকায় আরও অনেক দখলদারের নাম বাদ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন পরিবেশবাদীরা। দখল ও দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে একাধিকবার নোটিশ দিয়েছে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি। তাতে কোনো কাজ হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, ‘নদী দখলদারদের তালিকায় আমার নাম আছে, সেটা জানা নেই।’ নদী দখলের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘নদীতে এখন পৌরসভার আবর্জনা ফেলা হচ্ছে না। অন্য কেউ ফেলছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে।’এ ব্যাপারে কক্সবাজার পৌরসভার প্যানেল মেয়র শাহেনা আকতার পাখি বলেন, ‘শহরের বর্জ্য ডাম্পিংয়ের জন্য পাশের মিঠাছড়ি এলাকায় ডাম্পিং স্টেশন করা হয়েছে। বর্জ্য ওখানেই ফেলা হচ্ছে। তবে শ্রমিকরা মাঝে-মধ্যে বাঁকখালী নদীতেও ফেলছে।’
দখল দৌড়ে অন্যরাও :সবার কাছে তিনি ‘আতিকুল সিআইপি’। বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণাধীন সেতুর পাশেই বালু ও ইট দিয়ে ব্লক তৈরি করে নদী ভরাট করছে প্রভাবশালী আতিকুল ইসলামের লোকজন। এরই মধ্যে প্রায় ১০ একর জমি ভরাট করে অস্থায়ী কিছু শেডও নির্মাণ করা হয়েছে। শ্রমিকদের কাজ তদারক করছেন কর্মচারী মোক্তার আলম। তিনি বলেন, ‘বাঁকখালী নদীর যতদূর দেখা যায় সব আতিক সিআইপির। নদী যত ভরাট হচ্ছে ততই আমার মালিকের জমি বাড়ছে।’ তবে আতিকুলের দাবি, নদীর গতিপথ বদলে গিয়ে তার জমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভরাটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি ভরাট নয়। মূলত একটি জেটি নির্মাণের কাজ চলছে। জেটির অনুমোদন বিআইডব্লিউটিএ থেকে নিয়েছি।’
সরেজমিন দেখা যায়, নির্মাণাধীন সেতুর পাশে দুটি ঘর তৈরি করে আতিকুল দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামে সাইনবোর্ডও টানিয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, দখলবাজ চক্রের আরেক সদস্যের নাম সুলতান আহমেদ। যিনি আতিকুলের স্বজন। তার কাজ জালিয়াতি করে জমির কাগজ বানানো। এলাকার এক কাউন্সিলর জানান, কস্তুরাঘাট এলাকায় বাঁকখালী নদী দখলকারী এমন দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন।
দখল হচ্ছে যেভাবে : সরেজমিন দেখা গেছে, কস্তুরাঘাট থেকে সেতুতে যাওয়ার সংযোগ সড়কের উত্তর পাশসংলগ্ন প্যারাবনের বিশাল এলাকা কে বা কারা টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কিছুদিন আগেও এখানে বেড়া ছিল না। স্থানীয় কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, ২৫ মার্চ রাতে ৩০ থেকে ৪০ জন লোক এসে টিনের বেড়া দিয়ে প্যারাবনের বিশাল এলাকা ঘিরে ফেলে। ঘিরে রাখা স্থানের বন ধ্বংস করে তৈরি হয়েছে অসংখ্য টিনের ঘর। উত্তর দিকের কস্তুরাঘাট এলাকার সড়কের দুই পাশের প্যারাবন দখল করেও তৈরি হয়েছে ৪০টির বেশি ঘর। ঘরের পেছনে থাকা প্যারাবনের বিশাল এলাকা টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এভাবে প্যারাবনের অন্তত ১৫টি স্থান ঘিরে রাখার ছবি চোখে পড়েছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট এলাকায় গেল দুই মাসে প্রায় ৬০০ হেক্টর এলাকায় নদী দখল ও ভরাট করে ৪০ হাজার কেওড়া ও বাইনগাছ কেটে শতাধিক টিনের ঘর ও পাকা ভবন তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে দখল। গাছপালা উজাড় হওয়ায় ২০৫ প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট দিয়ে এক সময় চট্টগ্রামের সঙ্গে জাহাজ চলাচল ছিল। খুরুস্কুুল পর্যন্ত নদীর প্রস্থ ছিল দেড় কিলোমিটার। এখন নদীতে পানির প্রবাহ আছে কোথাও ৪০০ মিটার, কোথাও ২০০ মিটার। ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৫৯৫ মিটার দৈর্ঘ্যের সংযোগ সেতুর কাজ শুরুর পর থেকে নদীর বুকে সৃষ্ট প্যারাবন ও জলাভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘চোখের সামনে ভূমিখেকোরা নদী তীর দখল করে নানা স্থাপনা নির্মাণ করলেও প্রশাসন কিছুই করতে পারছে না। এতে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপন্নের পাশাপাশি নদীর মাছ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।’ কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আমিন আল পারভেজ বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাঁকখালী এলাকা পরিদর্শন করে দখলের সত্যতা পাওয়া গেছে। অচিরেই বাঁকখালী নদী দখলকারী ও প্যারাবনের গাছ নিধন করে স্থাপনা নির্মাণকারী এবং প্লট বাণিজ্যে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উচ্ছেদ করা হবে নির্মিত ও নির্মাণাধীন সব স্থাপনা।’