বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। বিসিএসের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই সর্বমহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিসিএস ক্যাডার হতে হলে একজন শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক পরীক্ষা (এমসিকিউ), লিখিত পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষার (ইন্টারভিউ) মতো কঠিন তিনটি ধাপে উত্তীর্ণ হতে হয়। পড়ালেখায় কঠিন অধ্যবসায়, প্রবল ধৈর্যশক্তি ও দেশসেরা মেধাবীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার পরই একজন চাকরিপ্রার্থী এ তিনটি ধাপে চূড়ান্ত সাফল্যের দেখা পায়।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে চূড়ান্ত ফলাফল পর্যন্ত সমগ্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ১.৫ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এত লম্বা সময়ের জার্নিতে অনেকেই শেষ পর্যন্ত সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছান, অনেকেই আবার ছিটকে যান। সেখানে এ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ, তাও আবার বিসিএসের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক খোদ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই! স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু ওলটপালট করে দেওয়া প্রশ্নফাঁসের এ ঘটনায় বেশ নড়েচড়ে বসেছে সরকার।
বিসিএসের প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৭ জন। তাদের মধ্যে জবানবন্দি দিয়েছেন ছয়জন। তাদের বক্তব্যে ও জবানবন্দিতে উঠে এসেছে প্রশ্নফাঁসে জড়িত আরও অন্তত ১১ জনের নাম। তাদের মধ্যে রয়েছেন, পিএসসির কর্মচারী-কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী।
অভিযোগ রয়েছে গত এক যুগে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে মূলত পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাত ধরেই। আর এসব ফাঁস করা প্রশ্নে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন অনেকেই।
প্রশ্নফাঁসে পিএসসির দুই উপ-পরিচালক, দুই সহকারী পরিচালক (এডি) এবং দুই অফিস সহায়কসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্তে ও আসামিদের জবানবন্দিতে উঠে আসা তথ্য যাচাই-বাছাই যেমন করা হচ্ছে, তেমনি নতুন করে নাম আসাদের চিহ্নিত করতে নজরদারি বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীটি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তারদের সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন, জব্দ করা মোবাইল ফোনের তথ্য ও জবানবন্দির ভিত্তিতে ফেঁসে যেতে পারেন পিএসসির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রশ্নপত্র কিনে চাকরি পাওয়া কর্মকর্তারা।
সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিএসসির পরীক্ষা-শাখা (নন-ক্যাডার), তথ্য-প্রযুক্তি শাখা, ইউনিট-১২ ও পিএসসি সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয়ের বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম সামনে আসছে। পিএসসির ডেসপ্যাচ রাইটার খলিলুর রহমান ও পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলামের জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আর গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর জবানবন্দি ও জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যে উঠে এসেছে পিএসসির একজন পরিচালক ও ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার নাম। সেসব যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
জবানবন্দিতে যে পাঁচ কর্মকর্তার নাম এসেছে
রেলওয়ের একটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় পিএসসির ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দির তথ্যমতে, প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত পিএসসির আরও পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম সামনে এসেছে। তারা বিভিন্ন সময়ে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসে জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন অফিস সহায়ক ও গাড়িচালকও। এই পাঁচজন হলেন— পিএসসির পরিচালক এনামুল বশির, সহকারী পরিচালক আবদুর রউফ, সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায় (মামলায় পলাতক আসামি), অফিস সহায়ক ডন কুমার ও গাড়িচালক আতাউর রহমান।
পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, প্রশ্নফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে এই পাঁচজনকে একসময় চাকরিচ্যুত করেছিল পিএসসি। পরে এনামুল বশির ও আবদুর রউফ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও আদালতের মাধ্যমে চাকরি ফিরে পান। অফিস সহায়ক ডন কুমার ও গাড়িচালক আতাউর রহমান চাকরিচ্যুত হয়েছেন দুই বছর আগে। সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায় গত বছর অবসরে গেছেন।
নাম না প্রকাশের শর্তে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এই পাঁচজনের বাইরে পিএসসির অন্তত ছয় কর্মকর্তাকে মনিটরিং করা হচ্ছে। আর পিএসসির বাইরে থেকে চক্রের সদস্য হিসেবে আরও নয়জনের তথ্য পাওয়া গেছে। তারা পরীক্ষার বুথ পরিচালনা ও টাকা সংগ্রহ করতেন। এ ছাড়া, মামলায় উল্লিখিত পলাতক আসামিদের অবস্থান শনাক্তে কাজ চলছে।
সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশকিছু নতুন তথ্য পেয়েছি। যেগুলো যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। আসামিদের রিমান্ডে পেলে সবকিছু বিষয় জানা যাবে।
বিসিএস ক্যাডার বা নন-ক্যাডারের চাকরি পেয়েছেন, এমন কারো তালিকা করা হচ্ছে কি-না? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তথ্য পেলে তালিকা তো হবেই। খলিলের (পিএসসির অফিস সহকারী খলিলুর রহমান) মাধ্যমে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। কাউকে ধরার আগে যেগুলো যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা কারাগারে থাকা ১১ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড আবেদন করেছি। রিমান্ড মঞ্জুর হলে এসব ব্যাপারে বিশদ জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
যাদের রিমান্ডে নিতে আবেদন করা হয়েছে তারা হলেন— পিএসসির উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম (৫৮), পিএসসির সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির (৪৯), উপ-পরিচালক আবু জাফর (৫৭), প্রতিরক্ষা ও অর্থ বিভাগ এসিসিডিএফের (বিওএফ) অডিটর প্রিয়নাথ রায় (৫১), মিরপুরের পোশাক কারখানার ব্যবসায়ী নোমান সিদ্দিকী (৪৪) ও ব্যবসায়ী জাহেদুল ইসলাম (২৭)।
যেসব জানতে রিমান্ড আবেদন সিআইডির
বাংলাদেশ রেলওয়ের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নন ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষার মূল প্রশ্ন কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং তাদের কে বা কারা প্রশ্ন সরবরাহ করেছে? প্রশ্নফাঁসের চক্রে আর কারা জড়িত? কোন প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে প্রশ্নফাঁস করা হতো? কার কী ভূমিকা? কীভাবে তাদের কাছ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করা হতো? কীভাবে নিয়োগপ্রার্থী পরীক্ষার্থীর কাছে ওই পদের প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করা হতো? কতজন নিয়োগপ্রার্থী পরীক্ষার্থীর কাছে ওই পদের প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করা হয়েছে? প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে চক্রটির দ্বারা মোট কত পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়েছে? এ ছাড়া, লেনদেন করা অর্থের সুবিধাভোগীদের শনাক্ত করা এবং মামলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আলামত উদ্ধারের নানা বিষয় জানতেই রিমান্ড আবেদন করে সিআইডি।
প্রশ্নফাঁসে মোটা অঙ্কের লেনদেন, মানি লন্ডারিং অপরাধ খোঁজা হচ্ছে
বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে পিএসসির ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদের মধ্যে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীও রয়েছেন। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সূত্র জানায়, ব্যাংক হিসাব জব্দ সংক্রান্ত চিঠি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক হিসাব জব্দ থাকবে বলেও চিঠিতে
উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রশ্নফাঁসে মোটা অঙ্কের লেনদেন হয়েছে। সেই টাকা কে কীভাবে আত্মসাৎ করেছেন, তা খতিয়ে দেখা হবে। মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য পেলেই নতুন মামলা দায়ের করা হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার, জামিনে থাকা পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ (রাবি) বিভিন্ন ক্যাম্পাসের সাবেক শিক্ষার্থীদের নজরে রাখা হয়েছে।
পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তে দুদকে পিএসসির চিঠি
বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে পিএসসির ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৯ জুলাই সাময়িক বরখাস্ত করে পিএসসি। ১০ জুলাই তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দেওয়া হয়।
পিএসসি থেকে সাময়িক বরখাস্তরা হলেন, দুই উপ-পরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির, ডেসপাচ রাইডার খলিলুর রহমান এবং অফিস সহকারী সাজেদুল ইসলাম।
গ্রেপ্তার ১৭ জনের দায় স্বীকার
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পিএসসির গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ছয়জন দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্যরা হলেন, পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক (ডিসপাস) সাজেদুল ইসলাম, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং বেকার যুবক লিটন সরকার। বাকি আসামিরা জবানবন্দি না দেওয়ায় তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিলসহ ১৪ জন এখনো পলাতক
প্রশ্নফাঁসের মামলায় পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়সহ এখন পর্যন্ত পলাতক রয়েছেন ১৪ জন। পলাতক অন্য আসামিরা, মো. শরীফুল ইসলাম, দীপক বনিক, খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, একেএম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ।
যা বলছে পিএসসি
প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের ধরতে পিএসসির গঠিত তদন্ত কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করছে। পিএসসির প্রশ্ন প্রণয়নকারীসহ সংশ্লিষ্ট কাউকে সন্দেহের বাইরে রাখা হচ্ছে না বলেও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
পিএসসির তদন্ত কমিটির প্রধান যুগ্ম সচিব ড. আব্দুল আলীম বলেন, তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। যেসব ইস্যু নিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করছি।