দেশে বিদেশি বিনিয়োগে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও আশানুরূপ বিনিয়োগ হচ্ছে না। যারাও বিনিয়োগে আগ্রহী তাদেরও আছে নানা বিড়ম্বনায় পড়ার ঘটনা। বিশেষ করে সরকার বিদেশি বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ থাকার কথা বলছে, কিন্তু হয়রানি, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতাসহ নানা অভিযোগ করেন বিদেশি উদ্যোক্তাদের অনেকে। এসবের কারণে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশিরা আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও নানা বাধা উপেক্ষা করে ব্যবসা শুরুর অনুমতি মিললেও এক জায়গায় ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে সব সেবা দেওয়া সম্ভব হলে পরিস্থিতির উত্তরণ হওয়ার সুযোগ আছে।
আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সরকারের একাধিক সংস্থা, মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে এই অবস্থার উত্তরণে কাজ করা হচ্ছে। ফলে সামনের দিনে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে সম্প্রতি সাতজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর গ্রেফতারের ঘটনায় বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাতজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ঢাকায় তাদের প্রতিষ্ঠিত একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বার্ষিক সভায় যোগ দিতে এসে গ্রেফতার হন কিছুদিন আগে।
তারা ঢাকায় হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স নামের একটি কোম্পানির পরিচালক। বীমার টাকা না পাওয়ার অভিযোগে চারজন গ্রাহকের মামলায় তারা আটদিন কারাগারে থাকার পর জামিন পেয়েছেন।
তাদের আইনজীবী অভিযোগ করেছেন, বিদেশ থেকে আসা এই বিনিয়োগকারীরা যাতে কোম্পানিটির মালিকানা ছেড়ে দেন, এমন পরিকল্পনা থেকে কোনো পক্ষ মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। এই ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ঢাকায় আরেকটি বীমা কোম্পানিতে বিনিয়োগকারী ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বজলুর রশীদ।
তিনি বলেন, বিশ্বাস করে আমরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করি। হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্সে উনারা (সাতজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ী) অন্ধ বিশ্বাসে বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তাদেরকে আজকে গ্রেফতার করা হলো। এই ধরনের হয়রানির মুখে পড়তে হয় আমাদের।
তিনি আরও বলেন, আমরা যাতে বিনিয়োগের অর্থ ছেড়ে দিয়ে বিলেতে ফেরত আসি, সেই পরিস্থিতি তৈরির জন্য আমাদের অনেক হয়রানি করা হয়।
যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনাটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে বলা হচ্ছে। একইসাথে মামলা থাকার বিষয়কেও কারণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে এসে মালিকানার প্রশ্নে হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ নতুন কিছু নয়।
বছর চারেক আগে বাংলাদেশে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করেছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নারী উদ্যোক্তা মমতাজ খান। তাকে তার বিনিয়োগের শুরু থেকেই খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেই অভিজ্ঞতা বর্ননা করতে গিয়ে মমতাজ খান জানিয়েছেন, নানা প্রতিবন্ধকতা ঠেলে বিনিয়োগ নিয়ে এগুনোর চেষ্টা করলেও শেষপর্যন্ত তাকে প্রকল্পের মালিকানা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হয়েছে।
তিনি বলেছেন, শেষ পর্যন্ত যখন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী জোগাড় করলাম। কিন্তু পরিস্থিতিটা আইডিয়াল ছিল না। সেজন্য আমি বাংলাদেশি ঐ পক্ষের কাছে আমার প্রকল্পটি দিয়ে চলে এসেছি।
কোনো বিদেশির ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন বাংলাদেশে কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা কোন এজেন্টকে অংশীদার করে তার মাধ্যমে যেতে হয়। একইভাবে বিদেশি বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশি পক্ষকে সঙ্গে রাখতে হবে।
আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমেরিকা বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের একজন নেতা আতিকুর রহমানের ঢাকায় বিনিয়োগের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেছেন, নিবন্ধনের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে শুরু করে পরিবেশ অধিদফতরসহ ১২টি সরকারি দফতর থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়।
বিনিয়োগের শুরু থেকে প্রতিটা ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা পোহাতে হয় এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, বিমানবন্দরে লাগেজ নিয়ে সমস্যা শুরু হয়। এরপর যখন নিবন্ধনের জন্য আপনি সচিবালয়ে যাবেন, তখন আপনার জুতার চেহারাও পরিবর্তন হয়ে যায় মানে জুতার সোল (শুকতলা) পর্যন্ত খসে যায় দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে। আমাদের নৈতিকতা হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিনিস। আমরা যদি ঘুষপ্রথা থেকে বের না হই তাহলে সমস্যা। ওখানেই বাধাটা বেশি পড়ে।
বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় বাধাগুলো
এদিকে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রকাশিত বিনিয়োগের পরিবেশ সংক্রান্ত রিপোর্ট বলছে, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সীমিত অর্থায়নের সুযোগের মতো বেশ কিছু কারণ বড় বাধা সৃষ্টি করছে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।
তবে সরকার বলছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকলেও সেগুলো সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে।
অনেক বাধা পেরিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারী নিবন্ধন পেলেও শেষ পর্যন্ত কম সংখ্যক বিনিয়োগ করে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি সিনিয়র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, একটা কারখানা তৈরির জন্য যে সব সেবা প্রয়োজন, সেগুলো এক জায়গায় পাওয়ার ক্ষেত্রে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা বলা হয়। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা রসিকতা করে বলেন, এই ওয়ান স্টপ সার্ভিস অনেক সময় ফুল স্টপ সার্ভিস হয়ে যায়।
‘এছাড়াও বিদ্যুৎ, গ্যাস বা পানির সব সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। নিষ্কণ্টক জমি পাওয়াও বেশ কঠিন। এসবের ব্যাপারে সরকার থেকে একশোটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার কথা বলা হলেও এখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় তা চালু করা যায়নি,’- বলেও জানান এই অর্থনীতিবিদ।
বড় বিদেশি বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের জন্য গেলে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের মহাপরিচালক আবুল হায়াত নুরুজ্জামান।
বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে কী করছে সরকার?
নানা অভিযোগের কারণে বিনিয়োগের জটিলতা কমাতে সরকার বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে ছয় বছর আগে। এই কর্তৃপক্ষ ৫০টির বেশি ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছে। এরপরও নানা প্রতিবন্ধকতার অভিযোগ রয়েছে।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য মোহসীনা ইয়াসমিন অবশ্য বলেছেন, এখনও কিছু সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা তারা করছেন।
তিনি বলেন, ওয়ান স্টপ সার্ভিসে আসলে আমরা এখনও সব সার্ভিসগুলোকে আনতে পারিনি। একটা ব্যবসা শুরুর নিবন্ধনের জন্য যে সার্ভিসগুলোর দরকার হয়, সেগুলো মোটামুটি আমরা এনেছি। আমাদের সার্ভিসে আমরা মনিটরিংও করে থাকি। কিন্তু কিছু সার্ভিস এখনও অনলাইন হয়নি। ফলে সেসব সংস্থায় সরাসরি যেতে হচ্ছে। সেখানে একটা দ্বৈত ব্যবস্থা আছে। সে কারণে কিছু কিছু জায়গায় বিনিয়োগকারীদের এখনও একটু সময় দিতে হয় এবং তারা সময়মতো পেপারগুলো পাচ্ছে না।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সেবার ঘাটতি যেমন রয়েছে, একইসাথে দুর্নীতি যে বড় বাধা সেটা সরকারেরও অনেকে স্বীকার করেন। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, সমস্যা কিছু আছে এবং সেগুলো সরকার চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করছে।
বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে আক্ষেপের কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আমাদের বেশ সংস্কারের প্রয়োজন আছে। আমরা প্রতিনিয়ত এগুলো মোকাবেলার চেষ্টা করছি। একদিনে তো ধুয়ে ফেলা যাবে না। আমরা বিষয়গুলোতে নজর দিচ্ছি।
মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সরকারের একাধিক সংস্থা এবং মন্ত্রণালয় দুর্নীতি কমানোর জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে সরকার আশা করছে। সূত্র: বিবিসি