রোববার (১০ আগস্ট) সকালে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক সংলাপে গভর্নর এ কথা বলেন। সংলাপের আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
বিনিয়োগ প্রসঙ্গে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমরা পাইপলাইনে বিনিয়োগ দেখতে পারছি। দেয়ার আর পজিটিভ সাইনস অব দ্যাট। কিন্তু আরেকটু সময় লাগবে। সামনে নির্বাচন, এই মুহূর্তে হয়তো বড় কোনো বিনিয়োগকারী আসতে চাইবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আসতে চাইবে না; পরবর্তী সরকার যদি সব চেঞ্জ করে ফেলে। লেটস টক টু দ্য নেক্সট গভর্মেন্ট, এটা খুব স্বাভাবিক পলেটিক্যাল প্রসেস।
তিনি বলেন, ‘৫ বিলিয়ন ডলার করে পণ্য আমদানি করছি। তাতে কী আমদানি কম হচ্ছে। বাজারে কী কোনো শর্টেজ আছে। কোনো পণ্যের অভাব আছে। হয়তো বলতে পারেন ক্যাপিটাল মেশিনারি ইমপোর্ট করছি না। লেজিটিমেট কোয়েশ্চেন? দ্য আনসার ইজ হু ইজ গোয়িং টু ইনভেস্ট ইন দিস এনভারনমেন্ট (এখন এখানে কে বিনিয়োগ করবে?)। আমরা খাদের কিনারায় ছিলাম সেখান থেকে যদি দ্রুত ফেরত আসতে না পারি তা হলে খাদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটা অনেক বেশি, যোগ করেন গভর্নর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, আমাদের দুটি চ্যালেঞ্জ ছিল। একটি হলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, আর রিফর্ম এজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়া। যাতে ভবিষ্যতে যে সরকারই আসুক তারা যেনো এটাকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আরও সুদৃঢ়ভাবে আর্থিকখাতকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার শুরুটা আমরা করে দিতে পারি সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যখন শাসন ভার গ্রহণ করলেন গতবছরের ৮ আগস্ট, তার এক সপ্তাহ পর ১৪ আগস্ট আমরা একটা আলোচনা করেছিলাম যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী? তখন আমাদের অর্থনীতি বেশ বিপদজনক অবস্থায় ছিল। রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন হচ্ছিল। টাকার বিনিময় হারের অবনমন হচ্ছিল খুব দ্রুত। সামষ্টিক অর্থনীতি অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। উচ্চমূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব বাড়ছিল, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমছিল। ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট সিপিডির পক্ষ থেকে এসব চ্যালেঞ্জের কথা বলি। এখন এক বছর পর যখন ফিরে তাকাচ্ছি তখন মূল্যায়নের একটা সময় এসেছে, প্রয়োজনীয়তা ও দেখা দিয়েছে, যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, নাজুক পরিস্থিতি থেকে ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে যাওয়ার চেষ্টা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের তারিখ মোটামুটি ঘোষণা হয়েছে। যত আলোচনা বা সমালোচনা করি না কেন, গোষ্ঠীগতভাবে রাজনীতিবিদরা আমাদের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নগুলো ধারন করেন।
মানিলন্ডারিং বন্ধ হওয়ার কারণে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রধান দায়িত্ব জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়া। অর্থনীতি স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে এই সময় অনেক কাজ হয়েছে। বড় বিষয় হচ্ছে মানিলন্ডারিং বন্ধ হয়ে গেছে। যারা লন্ডারিং করতো তারা তো পালিয়ে গেছে। যারা দেশে আছে তাদের হাতে টাকা নেই। মানিলন্ডারিং বন্ধ হওয়ার কারণে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের উচিত ছিল স্বৈরাচারের বাজেট চালিয়ে না যাওয়া। ওই বাজেট বাদ দিয়ে সামাজিক বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে নতুন বাজেট দিতে পারতাম। আমি মনে করি এটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।
৩৬৫ দিনে ম্যাজিক্যাল কিছু দেখতে পাইনি
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) বর্তমান সভাপতি হলেন শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গভর্নর বলে গেলেন বিপদের সময় জনশক্তি ও গার্মেন্টস খাত তাদের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন গত ৩৬৫ দিনে আমাদের জন্য কি করেছেন? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে টেক্সটাইল খাতে কর্পোরেট কর ১৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। ফিনিশড প্রোডাক্ট আসবে শুল্ক ছাড়া কিন্তু কাঁচামাল তুলা ২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তার ওপর চাঁদাবাজ তো আছেই। গ্যাস ও বিদ্যুৎ নেই। গত ৩৬৫ দিনে ম্যাজিক্যাল আমি কিছু দেখতে পাইনি। আমি গঠনমূলক সমালোচনা করছি, এটাকে তিরস্কার ভাববেন না।
তিনি বলেন, জনশক্তির জন্য কোনো ট্রেনিং সেন্টার করেছেন? মালয়েশিয়ায় দেখেছি ভারতীয় দক্ষ শ্রমিক যা নিজের দেশ থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে বেশি বেতনে কাজ করছে। আমাদের শ্রমিক ঘরমোছার কাজ করে নিন্ম বেতনে। বাজেটে ওই সেক্টরের জন্য কিছুই রাখা হয়নি। আমার সেক্টরে ১৮৫০টি কারখানা রয়েছে। সেখান থেকে ৩৬৫ দিনে ১৮৫১টি হয়নি। বরং কিছু কমেছে। এটাই বাস্তবতা। পলিসি সংস্কার হয়নি।
ব্যাংক লুটপাট প্রসঙ্গে রাসেল বলেন, লুটপাটে যে ব্যাংক নষ্ট হয়ে গেছে, তাকে আবার কেন টাকা দিচ্ছেন। আপনি গ্রাহককে টাকা দিয়ে ওই ব্যাংক বন্ধ করে দেন। চোরগুলোকে কেন টাকা দিচ্ছেন, চোরের মালিকানা কিন্তু কখনই নষ্ট হবে না। আবার ছোবল মারবে। ওই ব্যাংক বন্ধ করে ভালো ব্যাংকের শাখা বৃদ্ধি করে কর্মসংস্থান ঠিক রাখতে পারেন। তাতে সবাই খুশি হবে। ছোট একটি দেশে এতগুলো ব্যাংক সত্যিই অবাক করার মতো। বাংলাদেশের মতো পরিবারিকভাবে ব্যাংক কোথাও দেওয়া হয় না। ক্রিকেটে ছক্কা মারতে পারলেই তাকে লাইসেন্স দেওয়া হয়।
এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, আগের সরকারের সময়ে সমালোচনা করলে বলা হতো স্বাধীনতাবিরোধী। আর এখন বলা হয় ফ্যাসিবাদের দোসর। শুধু দোসর খোঁজেন, ভাসুরকে আড়াল করছেন কেন? একই পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে ভিন্ন ফল আশা করেন কীভাবে?
বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে চাঁদাবাজির প্রভাব এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বছরে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। সেটা রাজনীতি ও সাধারণ মানুষের কেমন প্রভাব পড়ে। আলোচনা করা দরকার।