দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি বলতে শুধু শুক্রবার ছিল। তবে বৃহস্পতিবার ছিল হাফ স্কুল। অর্থাৎ দুপুরে স্কুল ছুটি হয়ে যেতে। হঠাৎ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, ২০২৩ সাল থেকে সপ্তাহে দুইদিন শুক্র ও শনিবার স্কুল ছুটি থাকবে। যদিও ছুটি একদিন বাড়ানোর কোনো কারণ বলেননি তিনি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কথা থাকলেও ২০২২ সালে আগস্ট মাসে হঠাৎ করে জানানো হয়, এখন থেকে শনিবার স্কুল বন্ধ থাকবে। এরপর থেক শুক্র-শনি দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটি ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
দেড় বছর পর আজ (৪ মে) থেকে ফের শনিবারে বিদ্যালয়ে শুরু হলো পাঠদান। এতে মিশ্র প্রতিত্রিয়া দেখিয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে গিনিপিগ বানিয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে সিদ্ধান্ত বদল দেখলে মনে হয়, শিক্ষার্থী যেন সরকারের ট্রায়ালের মাঠ। তাদের দিয়ে সরকার এক্সপেরিমেন্ট চালায়। এটাতে শিক্ষার ব্যাপাক ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
রাজধানী আজিমপুর স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রীর বাবা শাহজাহান মিয়া বলেন, সরকার কী স্কুলশিক্ষার্থীদের দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট (পরীক্ষা) চালায়? না হলে দেড় বছর আগে কেন শনিবার ক্লাস বন্ধ করে আবার চালু করা হলো। এছাড়া তাপপ্রবাহের কারণে ক্ষণে ক্ষণে সিদ্ধান্ত বদল করতেছে। আজ ২৫ জেলায় স্কুল বন্ধ। বাকি জেলায় স্কুল খোলা। তাহলে কি ওই ২৫ জেলার বাচ্চারা পিছিয়ে পড়বে না। এসব আজগুবি সিদ্ধান্তের কোনো মানে হয় না।
ভিকারুননিনা নূন স্কুলের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাপপ্রবাহ বাড়ার পর সরকার একের সময় একেক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সবার আপত্তির মুখে গত সপ্তাহ শুধু রোববার স্কুল খোলা রাখলো। তারপর সোমবার ঠিকই বন্ধ করতে হলো। এরপর হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে মঙ্গলবার খোলা রাখলো। তীব্র গরমের মধ্যে দুইদিন ক্লাস করিয়ে কী হাসিল করতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা আমার বুঝে আসেন না।
এদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, যুগের যুগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রেওয়াজ ছিল বৃহস্পতিবার হাফ, শুক্রবার মাফ, শনিবার বাপরে বাপ। কিন্তু ২০২২ সালে সরকার বিদুৎ সাশ্রয়ের জন্য ২০২২ সালের আগস্ট মাসে থেকে শনিবার ক্লাস বন্ধ রাখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার হাফের পরিবর্তে সপ্তাহে দুই দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়।
তীব্র তাপপ্রবাহে কারণে ফের শনিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদিও এ সিদ্ধান্ত স্থায়ী নয় বলে জানিয়েছে শিক্ষামন্ত্রী। এরপরও সন্তুষ্ট নয় শিক্ষকরা। তারা বলছেন, সরকার শিখন ঘাটতির কথা বললেও প্রকৃত পক্ষে বিদ্যালয়ে শিখন ঘাটতি নেই।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সপ্তাহে দুই দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির আভাস দেন। এটি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু আগস্টে দেশে ডলার ও জ্বালানি সংকট দেখা দিলে বিদুৎ সাশ্রয়ে সপ্তাহে দুইদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হয়। পূর্বের বৃহস্পতিবার হাফ ক্লাস বাদ দেওয়া হয়।
গত ২৬ মার্চ রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, পবিত্র রমজান মাসে স্কুল খোলা থাকা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রচার-অপপ্রচার হয়েছে। বছরের ৫২টি শনিবার রয়েছে। সেখানে যদি বিদ্যালয় কিছুটা খোলা রেখে যদি রমজানের ক্ষেত্রে যে বিতর্ক হচ্ছে, বিতর্ক সৃষ্টির অপপ্রয়াস যারা করছে তাদের অপ্রয়াস যাতে বন্ধ করতে পারি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত শীতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। সব মিলিয়ে চলতি বছর ১০ কর্মদিবসের শিখন ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি পূরণ করতে শনিবার ক্লাস খোলা রাখা হয়েছে। তবে শনিবার স্কুল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত অস্থায়ী।
এ সিদ্ধান্ত অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম বিপ্লব বলেন, শিখন ঘাটতি আছে আমরা বুঝি না, আর মন্ত্রণালয়ের লোকজন বুঝলো? তাপপ্রবাহের কারণে যে ঘাটতির কথা বলা হচ্ছে, সেটা আমরা রমজানে পূরণ করেছি। দুইদিন ছুটি থাকা শিক্ষকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটির নেতারা জানান, কোনো দুর্যোগ শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী সৃষ্ট নয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ হতেই পারে। পূর্বেও হয়েছে। সে কারণে নির্ধারিত ছুটি কমিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর নজির বিগত সরকার আমলে দেখি নাই। মন্ত্রণালয়ের এহেন সিদ্ধান্তে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত বৈ কিছু নয়। কারণ নির্ধারিত ও সাপ্তাহিক ছুটিতে শিক্ষার্থীরা পাঠ সংশ্লিষ্ট ‘বাড়ির কাজ’ সম্পন্ন করতে পারেন। অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক চিকিৎসা নেয়া, আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ানো, আচার- অনুষ্ঠান ও বিশ্রামসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। ছুটি-ছাটা নিয়ে আচমকা সিদ্ধান্ত নেওয়ায় স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সামাজিক, শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিরও সম্মুখীন হয়।
নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, জাতীয় দিবসগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থান নিতে হচ্ছে, অথচ সে দিন অন্যদের ছুটি। শুধু তাই নয়, শিখন ঘাটতি পূরণ করতে গত বছরের গ্রীষ্মকালীন ছুটি ও শীতকালীন ছুটি বাতিল করা হয়েছে। চলতি বছরে রমজানের ছুটি কমানো হয়েছে যা মোটেই সুবিবেচনাপ্রসূত হয়নি। এসব সিদ্ধান্ত নির্লিপ্ততারই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করে তারা।