ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত হয়। কিন্তু বিচার হয় না। এতে দুর্নীতি আরও বেড়ে যাবে। একাধিক ব্যাংক এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে চলে যাচ্ছে। বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই। ঋণ দেওয়ার একটা সীমা আছে। সে সীমা অতিক্রম করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকও সে ঋণে সায় দিচ্ছে। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েও অনেকে ঋণ নেন। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এভাবে বেআইনিভাবে ঋণ দেওয়া-নেওয়া বেড়ে যাওয়ায় আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলে মনে করেন শীর্ষ ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বুধবার রাজধানীর বণিক বার্তার দ্বিতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২১-এ এসব কথা বলেন তারা।সম্মেলনে উপিস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান ৪ জন গভর্নর। দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাসরুর আরেফিন স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে সম্মেলনটি শুরু হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। পাঁচ দশকের উন্নয়ন অভিযাত্রায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ শিরোনামে সম্মেলনের মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।
সম্মানিত অতিথি হিসাবে আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ড. আতিউর রহমান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, হামীম গ্রুপের কর্ণধার একে আজাদ, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতাউর রহমান প্রধান ও ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মনিরুল মওলা। সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি অংশগ্রহণ করেননি।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ঋণ ফেরত না পেলে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায়। আবার যারা ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই। তবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশংসা করেন তিনি। সম্মেলনে এক ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। কিন্তু সে তদন্তের আলোকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
এভাবে দুর্নীতি সংক্রমিত হয়। তিনি বলেন, আর্থিক দুর্নীতি বা যে কোনো তদন্ত প্রতিবেদন টেবিলের ড্রয়ারে চলে গেলে দুর্নীতির প্রবাহ আরও বেড়ে যাবে। ফরাস উদ্দিন বলেন, কোভিডকালে যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে এর ৮০ শতাংশই পেয়েছেন বড় উদ্যোক্তারা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সেভাবে প্রণোদনার অর্থ পাননি। বিষয়টি নিয়ে আরও ভাবতে হবে। কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি মানি লন্ডারিং ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠোর ভূমিকা পালনের ওপর জোর দেন সাবেক এ গভর্নর।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, একাধিক ব্যাংক এক ব্যক্তির হাতে চলে যাওয়া, এটা রোধ করতে আমরা এখনও শিখিনি। তিনি বলেন, দেশের অনেক সেক্টরে অযোগ্য লোক রয়েছে এ কথা সত্য। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকই সম্ভাব্য একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানকার প্রধানরা শতভাগ যোগ্যতাসম্পন্ন। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরকে সবচেয়ে ভালো বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সব গভর্নর যথেষ্ট ভালো। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বর্তমান গভর্নর।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। এটা কাগজে-কলমে থাকলেও কার্যকর নেই। ড. আতিউর রহমান বলেন, কোভিড-১৯-এর কারণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সবচেয়ে বড় যে তিনটি খাত ভূমিকা রেখেছে তার মধ্যে রেমিট্যান্স অন্যতম। যে কারণে রেমিট্যান্সে প্রণোদনা আরও এক শতাংশ বাড়ানো উচিত বলে মনে করি। সাবেক এ গভর্নর বলেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে দেশের কৃষি খাত ছিল রক্ষাকবচ।
এর পরেই ভূমিকা রেখেছে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি খাত। এছাড়া টেকসই অর্থনীতি বাস্তবায়নে আটটি সুপারিশ করেন তিনি। তারমতে, খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, বিশ্বের শীর্ষ ৪১টি শীর্ষ অর্থনীতি দেশের মধ্যে মাত্র আটটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ছিল গত অর্থবছরে। তার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল।
এটি সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যথাযথ যোগসূত্র থাকার কারণে। এ সময় তিনি বলেন, অর্থনৈতিক এ প্রবৃদ্ধিকে আরও গতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাঝে সমন্বয়ের প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবির বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় প্রবেশের সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি তেমন একটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েনি। দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা রাখতে এবং কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্মেলনের আলোচনায় অংশ নিয়ে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একে আজাদ বলেন, একক গ্রাহকের ব্যাংক ঋণ নীতিমালা আছে। এ নীতিমালার অতিরিক্ত ঋণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রস্তাব যায় এবং সেটি ঠিকই অনুমোদন হয়ে যায়।
এটা বন্ধ করা গেলে খেলাপি ঋণ কমবে। সুদের হার আরও কমানো যাবে। ব্যাংকগুলোকে অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ দিতে হয়। খেলাপি ঋণ সব চেয়ে বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। তারমতে, রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংককে একীভূত করে এক ব্যাংকে রূপান্তরিত করলে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। একে আজাদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে যদি অনেক বিষয়ে স্বাধীনতা দেওয়া যায় তাহলে আরও কর্মসংস্থান হবে, অর্থনীতির সম্প্রসার ঘটবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঋণে এখনো অনেক হয়রানি হয় বলে মন্তব্য করে তা বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককে নজর দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
আলোচনায় অংশ নেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান। তিনি বলেন, একজন গ্রাহকের ১১টি ঋণ আছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে নিয়েছেন একটি ঋণ। আর ১০টি ঋণ নিয়েছেন বেসরকারি ব্যাংক থেকে। মজার বিষয় হলো-বেসরকারি ১০টি ঋণ তার নিয়মিত। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের ঋণটি তার শতভাগ খেলাপি। এখন চাপ দিচ্ছেন পুনঃতফসিল করার জন্য। এবার বলেন-সরকারি ব্যাংকের কী করণীয়।