চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানা পুলিশের হেফাজতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর (৬১) মৃত্যুকে ঘিরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্রেফতারের পর শহীদুল্লাহ থানায় অসুস্থবোধ করেন। পরে হাসপাতালে পাঠানো হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় চান্দগাঁও থানার দুই এএসআইকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি।
বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-পিআর) স্প্রীনা রানী প্রামাণিক। তিনি বলেন, দুদকের সাবেক কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সিএমপি।
কমিটিতে আছেন—সিএমপির ডিবি (উত্তর) বিভাগের উপ-কমিশনার, সিএমপির (উত্তর) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এবং সিটিএসবির সহকারী কমিশনার। অনুসন্ধান শেষে মতামতসহ আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুর ঘটনায় তার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তার গ্রেফতারের ক্ষেত্রে কোনও ধরনের বিধিবহির্ভূত কাজ হয়েছে কিনা এবং থানায় নিয়ে আসার পর তার সঙ্গে নিয়মবহির্ভূত কোনও আচরণ করা হয়েছে কিনা তা নির্ণয়ের জন্য এ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হলো।
শহীদুল্লাহর ছেলে ক্যাপ্টেন নাফিস শহিদ বলেন, মঙ্গলবার রাতে বাবাকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমার চাচারা এবং বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী সেখানে যান। থানায় নেওয়ার পর কেউ যাতে বাবার সঙ্গে দেখা করতে না পারে সে জন্য চান্দগাঁও থানার মূল ফটক বন্ধ করে দেয় পুলিশ। তিনি হার্টের রোগী। তার সব সময় ইনহেলার আর মেডিসিন প্রয়োজন হয়। পুলিশ সেগুলো বাবার কাছে পৌঁছাতে দেয়নি। আমার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি। পাশাপাশি জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানাচ্ছি।
শহীদুল্লাহর স্ত্রী ফৌজিয়া আনোয়ার বলেন, আমার স্বামী রাত সাড়ে ৮টায় চকবাজার কেয়ারিতে মিটিংয়ে যাচ্ছেন বলে বাসা থেকে বের হন। পরে শুনলাম, চেয়ারম্যানঘাটার একটি পরিচিত ব্যক্তির ফার্মেসি থেকে তাকে পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকে দুই ব্যক্তি টেনেহিঁচড়ে চান্দগাঁও থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে আমার দেবর-ভাসুরসহ অনেক প্রতিবেশী তার ওষুধপত্র এবং ইনহেলার নিয়ে থানায় যান। তবে পুলিশ তাদের থানার ভেতর ঢুকতে দেয়নি। আমার ছেলে ওষুধ-ইনহেলার দেওয়ার জন্য পুলিশের পায়ে পর্যন্ত পড়েছে। তারপরও তাদের মন গলাতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামীকে থানায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি কি বড় সন্ত্রাসী নাকি জঙ্গি? তার জন্য থানার ফটক বন্ধ করতে হবে কেন? আমার স্বামীকে ওষুধ না দিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
এদিকে, পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর লাশ হাসপাতালে রেখে চান্দগাঁও থানা পুলিশ বিনা ময়নাতদন্তে হস্তান্তরের জন্য একটি আবেদন তৈরি করে। ওই আবেদনে পরিবারের পক্ষ থেকে সাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে পরিবারের সদস্য এবং চট্টগ্রামের দুদক কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।
এ প্রসঙ্গে চান্দগাঁও থানার ওসি খাইরুল ইসলাম বলেন, সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে রাতে গ্রেফতারের পর শরীর খারাপ লাগছে বলে জানান তিনি। তখন আমার কক্ষে এনে বসিয়েছি। পরে তার ভাইদের জানিয়ে বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি আরও বলেন, সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে থানায় কোনও ধরনের টর্চার করা হয়নি। একটি মারামারি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল। ওই গ্রেফতারি পরোয়ানা মূলেই তাকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার করে থানা পুলিশ।
সেই দুই এএসআই প্রত্যাহার
চট্টগ্রামের পুলিশ হেফাজতে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক উপপরিচালক ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুর ঘটনায় চান্দগাঁও থানার সেই দুই সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ইউসুফ আলী এবং সোহেল রানাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) দুজনকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। সিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-পিআর) স্পীনা রানী বৃহস্পতিবার দুপুরে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, এএসআই মো. ইউসুফ আলী ও এএসআই মো. এটিএম সোহেল রানাকে এখন সিএমপির দামপাড়া পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) রাতে সিএমপি’র চান্দগাঁও থানা পুলিশ দুদকের সাবেক কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে গ্রেফতার করে। পরে থানা হাজতে তার মৃত্যু হয়।
শহীদুল্লাহ নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন মহুরি বাড়ি এলাকার পৈত্রিক বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। সেখানে তিনি জসিম নামে স্থানীয় কথিত এক যুবলীগ নেতার সাথে ভূমি বিরোধ মামলায় জড়িয়ে পড়েন। এ মামলায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
শহীদুল্লাহ সর্বশেষ চট্টগ্রামের দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এ উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে ২০০৭ সালের ১২ জুলাই তিনি অবসর নেন।
এদিকে থানা হেফাজতে পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে দুদকের সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (ডিইউএসএ)।