বাড়তি দামে টেন্ডার ছাড়াই সরাসরি পদ্ধতিতে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয় এবং আর্থিক বিধিবিধান লঙ্ঘন করে অর্থ ব্যয়সহ নানা ফাঁকফোকরের সুযোগে সরকারের বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাসহ সংশ্লিষ্ট কুশীলবদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির খোঁজে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের টিম গঠন করার পর ইভিএম ক্রয় সংক্রান্ত নথিপত্র তলব করে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
চিঠিতে অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা ও অন্যান্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও সরকারি আর্থিক বিধি বিধান লংঘনপূর্বক পরীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণের পর টেন্ডার ছাড়াই বাজার মূল্যের চেয়ে ১০ গুণ বেশি দামে দেড় লাখ নিম্নমানের ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয় করে সরকারি প্রায় ৩ হাজার ১৭২ কোটি টাকা ক্ষতিসাধন করেছেন।
দুদকের অভিযোগে আরও যেসব ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে তাদের মধ্যে রয়েছে- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) সে সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুলতানুজ্জামান মুহাম্মদ সালেহ উদ্দিন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি বেশ আগের, পুরোপুরি মনে নেই। তদন্তকালে যদি আমার কাছে আসে তখন বলা যাবে। এ মুহূর্তে বলতে পারব না। তবে এটুকু মনে পড়ে শক্তিশালী একটি ট্যাকনিক্যাল কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) মাধ্যমে মেশিন ক্রয় করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি এককভাবে কাজ করেছে আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পেমেন্ট হয়েছে। এর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সম্পৃক্ততা ছিল না, তাই দুর্নীতির প্রশ্ন আসে না।
তিনি আরও বলেন, ইভিএমের ওয়ারেন্টি নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে বলে জানি। আসলে ওয়ারেন্টির বিষয়টি অনেক কিছুর ওপরে নির্ভর করে। কারণ, ইভিএম স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহার হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আবার আনা হয়েছে। আনা-নেওয়ার যাতায়াত সব জায়গায় একরকম নয়, সে কারণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দুদক তদন্ত করুক, তদন্তে যা আসবে তাই হবে।
জানতে চাইলে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদকের অনুসন্ধান আইন ও বিধি অনুসরণ করে চলে। অনুসন্ধান টিম কাজ করছে। তাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
অভিযোগে কী কী বলা হয়েছে
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন টেন্ডার ছাড়াই তড়িঘড়ি করে ইভিএমের বড় লট সংগ্রহ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ডেলিগেশন পদ্ধতিতে (অর্পিত কাজ) কেনার বিধান রেখে প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পাস করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার।
ইভিএম কেনার বিষয়ে ইসি সচিবালয় ও বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে ইভিএম সরবরাহ করা হয়েছে। মূল যন্ত্রটি মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির মাধ্যমে চীন থেকে আমদানি করা হয়। প্রথমে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তৎকালীন সিইসির। তবে শেষমেশ মাত্র ছয়টি আসনে এ মেশিন ব্যবহারে করে ভোটগ্রহণ করা হয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে কিছু সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি ইভিএমের জন্য খরচ হয় দুই লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ টাকা। এ হিসাবে দেড় লাখ ইভিএম কিনতে সরকারের ব্যয় তিন হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। বিপত্তিটা এখানেই।
সরকারের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের দাবি, বাজার দরের চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি দামে ইভিএম কেনা হয়েছে। ফলে ইভিএম কিনতে ৩৪৩ কোটি টাকার মতো খরচ হওয়ার কথা ছিল। সে হিসাবে তিন হাজার ১৭২ কোটি টাকা অতিরিক্ত অর্থ খরচ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে লুটপাটের সুযোগ দিতেই কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রকল্প গ্রহণের সময় কাগুজে ব্যালটের তুলনায় ইভিএমে ভোট হলে নির্বাচনী ব্যয় কমবে বলে যুক্তি দেখানো হলেও বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টো। ব্যালটের তুলনায় ইভিএমে ভোট গ্রহণে দেড় গুণ অর্থ ব্যয় হয়। ইভিএম পরিবহন, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, ভোটার এডুকেশন ও বেশি ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তা মোতায়েনের কারণে এ খরচ বাড়ে।
সংসদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনী খরচ ও প্রশিক্ষণ ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কাগজের ব্যালটের তুলনায় ইভিএমে ভোটগ্রহণের ফলে সংসদ নির্বাচনে ২৯ শতাংশ, পৌরসভা নির্বাচনে ৭৫ শতাংশ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৫১ শতাংশ বেশি ব্যয় হয়েছে। তড়িঘড়ি করে গ্রহণ করা এ প্রকল্পে ইভিএম সংরক্ষণ, পরিবহন ও মেরামত খাতে কোনো ব্যয় ধরা হয়নি। যার কারণে এটা এখন ইসির গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে বর্তমানে ৪০ হাজারের মতো ভালো রয়েছে। বাকি ইভিএমগুলো নষ্ট। যদিও হাবিবুল আউয়ালের কমিশন এসব নষ্ট ইভিএম মেরামত করার উদ্যোগ নিয়ে এক হাজার ২৬০ কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয়ের একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিল। অর্থ বিভাগ ওই টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সেগুলো আর মেরামত করা যায়নি।
ইভিএম মেশিনের ওয়ারেন্টি নিয়েও শুভংকরের ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্প গ্রহণের সময় পরিকল্পনা কমিশন থেকে ইভিএমের ওয়ারেন্টি ১০ বছর নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। তবে সিএজি অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী— ইভিএমের ওয়ারেন্টি দেওয়া হয় মাত্র এক বছর। এ কারণে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ইভিএম মেরামত যোগ্য হলেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সেই সুবিধা পাওয়া যায়নি।
দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে ৪০ হাজারের মতো বর্তমানে ব্যবহার উপযোগী। বাকিগুলোর মধ্যে প্রায় ২৪ হাজার একেবারেই অকেজো। ৮৬ হাজার ইভিএম মেরামতযোগ্য। প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার ৭০৯ কোটি টাকা ব্যয় হলেও ইভিএম সংরক্ষণের জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে ওইসব ইভিএম সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে ইসি কর্মকর্তাদের। ইভিএম সংরক্ষণে বিএমটিএই-এর ওয়্যারহাউজ ব্যবহার বাবদ এরই মধ্যে ৬০ কোটি টাকার বেশি বকেয়া পড়েছে নির্বাচন কমিশনে।
ইভিএম যাচাইয়ে দুদকের অভিযান
নিম্নমানের ইভিএম কেনার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৬ জানুয়ারি অভিযান পরিচালনা করেছে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম। অভিযানে ইসির কেনা সেই ইভিএম মেশিনে ত্রুটি ধরা পড়েছে। ইসি ভবনে দুদকের উপ-পরিচালক নুর আলম সিদ্দিকীর নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
দুদকের উপ-পরিচালক নুর আলম সিদ্দিকী বলেন, ২০১৮ সালে ইসি দেড় লাখ ইভিএম মেশিন ক্রয় করে। এই মেশিনের মধ্যে ১ লাখ ৫০০ মেশিন ব্যবহারের অনুপযোগী বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযানকালে ইভিএমগুলো ইসির তিন জায়গায় সংরক্ষণের তথ্য পাওয়া যায়। যার মধ্যে রয়েছে- ইসি, বিএমটিএফ (বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড) ও ইসির ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়। মেশিনগুলো থেকে কিছু র্যানডমলি যাচাই করে দেখা যায়— প্রতি তিনটি মেশিনের একটি ত্রুটিপূর্ণ। ইসিতে ৬১৮টি ইভিএম সংরক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়া বিএমটিএফ ৮৬ হাজার এবং ইসির ১০টি আঞ্চলিক অফিস ৬২ হাজার ইভিএম সংরক্ষণ করছে। অভিযানকালে নিম্নমানের মেশিন ক্রয় করার ক্ষেত্রে কিছু রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়। অভিযান শেষে এনফোর্সমেন্ট টিমও অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছে বলে জানা গেছে।
২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একনেক সভায় অনুমোদন পায় ইভিএম প্রকল্পটি। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও এখনও তা ইসিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। নির্বাচন ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।