দুই বছরে বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ‘উদ্বেগজনক’ বলছেন শিক্ষাবিদরা। তাদের মতে, প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ নিশ্চিত করা গেলেও মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। এ জায়গায় সরকারকে আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করা ও ধরে রাখার জন্য সরকার প্রতি বছর উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই, খাবার দেওয়াসহ অন্যান্য খাতে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। এরপরও বিভিন্ন পর্যায়ে এত অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী কেন ঝরে পড়ছে— এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নতুন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এ বিষয়ে বেশি মনোযোগ দেবেন— জানিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১০ এর শিক্ষানীতির আলোকে নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক অথবা স্বল্পমূল্যে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। কোনো শিক্ষার্থী যাতে নিম্ন মাধ্যমিক থেকে ঝরে না পড়ে, সেই প্রয়াস থাকবে।
‘মাধ্যমিকে কেন ঝরে পড়ছে, এটা মোটামুটি আমরা সবাই জানি। কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। তাই ঝরে পড়া রোধে আমি গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে গিয়ে চিন্তা করছি। নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা একেবারে বিনামূল্যে না হলেও স্বল্পমূল্যে যাতে পড়াশোনা করতে পারে সে উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি ঝরে গেছে এমন শিশুদের কর্মমুখী একটি কোর্সের মাধ্যমে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা থাকবে।’
আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে একযোগে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হবে। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এ বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ২৯ হাজার ৭৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবে। তাদের মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষার্থী ১৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৬ জন। অনিয়মিত পরীক্ষার্থী তিন লাখ ১১ হাজার ৫১৩ জন।
শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২১ সালে জেএসসি পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে নবম শ্রেণিতে (২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ) রেজিস্ট্রেশন করেছিল ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৩ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে এবার এসএসসি পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছে ১৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৬ জন। অর্থাৎ নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেও এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেনি পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩৭ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ছাত্রী আট লাখ ৯১ হাজার ৭২১ জন এবং ছাত্র আট লাখ ১৮ হাজার ৫৭৫ জন। অর্থাৎ তারা শিক্ষার মূল স্রোত থেকে হারিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এবার ঝরে পড়ার হার একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। কারণ, ব্যাচটি করোনাপরবর্তী ব্যাচ। যারা কম বিষয় বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়। এবার যেহেতু পূর্ণ সিলেবাস এবং সব বিষয়ে পরীক্ষা হচ্ছে তাই তারা হয়তো কুলিয়ে উঠতে পারেনি। তার সঙ্গে বাল্যবিয়ে, কর্মজীবনে প্রবেশসহ অন্যান্য কারণ তো রয়েছে।’
তবে শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, করোনার ধাক্কায় দেশে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার অনেক বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে সব স্তরের শিক্ষায় প্রতি বছর ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঝরে পড়ার প্রকৃত তথ্য নিরূপণ করা জরুরি। সেজন্য বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ‘অতিমাত্রার শিক্ষাব্যয়’-কে দায়ী করছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, সমাজের অতিদরিদ্র ব্যক্তিটিও চান তার সন্তান লেখাপড়া করুক। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে দেশে যে ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, নোট-গাইড আর প্রাইভেট-কোচিংয়ের যে দৌরাত্ম্য চলছে, কম আয়ের পরিবারগুলো এ ধাক্কা সামলাতে পারছে না বলেই ঝরে পড়ার ঘটনা ঘটছে।
ঝরে পড়ার হারে মেয়েরা এগিয়ে
২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১১ লাখ ৭৪ হাজার ১৭ মেয়ে। এসএসসির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেছে আট লাখ ৯১ হাজার ৭২১ জন। অর্থাৎ ঝরে পড়েছে দুই লাখ ৮২ হাজার ২৯৬ জন। অন্যদিকে, নবম শ্রেণিতে ছেলেরা রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১০ লাখ ৭০ হাজার ৭১৬ জন। তাদের মধ্যে এসএসসিতে ফরম পূরণ করেছে আট লাখ ১৮ হাজার ৫৭৫ জন। ঝরে পড়েছে দুই লাখ ৫২ হাজার ১৪১ জন। ছেলেদের তুলনায় মেয়ে ৩০ হাজার ১৫৫ জন বেশি ঝরে পড়েছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এ স্তরের মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। এ ছাড়া, শিক্ষার ব্যয় বেড়ে যাওয়া, দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অনেকে ঝরে পড়েছে।
জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্কুল ভর্তি, পাস ও ভালো ফলাফলের দিক থেকে মেয়েরা যেমন এগিয়ে তেমনি ঝরে পড়ার হারেও তারা এগিয়ে। এটি উদ্বেগজনক। বাল্যবিয়ে, নিরাপত্তাহীনতা, পরিবার থেকে মেয়েদের পেছনে শিক্ষায় বিনিয়োগ না করার প্রবণতা মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিতে বারবার প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে।
অনিয়মিত পরীক্ষার্থী ৩ লাখ ১১ হাজার ৫৩৩ জন
এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এক থেকে একাধিক বিষয়ে পরীক্ষা দেবে তিন লাখ ১১ হাজার ৫৩৩ পরীক্ষার্থী। ফলে নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলিয়ে পরীক্ষায় বসবে ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন।
অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের কেউ এক বা একাধিক বিষয়ে ফেল করেছিল বা কাঙ্ক্ষিত নম্বর না পাওয়ায় মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেবে। এর মধ্যে এক বিষয়ের পরীক্ষা দেবে সবচেয়ে বেশি এক লাখ ৯০ হাজার ৭৪৩ জন। দুই বিষয়ে পরীক্ষা দেবে ৫৯ হাজার ৫৪৫ জন। তিন বিষয়ের পরীক্ষা দেবে ১৯ হাজার ৩৩৫ জন, চার বিষয়ের পরীক্ষা দেবে পাঁচ হাজার ৬৫০ জন। নতুন করে সব বিষয়ে পরীক্ষা দেবে ৩৬ হাজার ২৬০ জন।
কোন বোর্ডে কতজন ঝরে পড়ল
বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংখ্যাগত হিসাবে ঝরে পড়ার হারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সবচেয়ে এগিয়ে। ২০২২ সালে এ বোর্ডে চার লাখ ৩৫ হাজার ৬২৬ জন নিবন্ধন করলেও পরীক্ষা দিচ্ছে তিন লাখ ৩৪ হাজার ৯২০ জন। ঝরে পড়েছে এক লাখ ৭০৬ জন। এভাবে রাজশাহী বোর্ডে ঝরে পড়েছে ৩৫ হাজার ২৯১ জন, কুমিল্লা বোর্ডে ৫৪ হাজার আটজন, যশোর বোর্ডে ৪৪ হাজার ৫২২ জন, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৩৫ হাজার ১৩৭ জন, বরিশাল বোর্ডে ১০ হাজার ১২৫ জন, সিলেট বোর্ডে ২৭ হাজার ২০১ জন, দিনাজপুর বোর্ডে ২৭ হাজার ৪৯২ জন, ময়মনসিংহ বোর্ডে ১৬ হাজার ৫৭৩ জন ঝরে পড়েছে। মাদ্রাসা বোর্ডে তিন লাখ ৫১ হাজার ৪০৮ জন নিবন্ধন করলেও পরীক্ষা দিচ্ছে দুই লাখ ৩২ হাজার ২৪৯ জন। টেকনিক্যাল বোর্ডে এক লাখ ৭৭ হাজার ১৭৯ জন নিবন্ধন করলেও পরীক্ষা দিচ্ছে এক লাখ ১২ হাজার ৯৫৬ জন।