এখন, ১০০ দিন পরে, শেখ হাসিনা আবার ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তবে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। আগস্টের ৫ তারিখে, যখন শেখ হাসিনা ভারতে আসেন, তখন দিল্লির ধারণা ছিল, এটা শুধু একটি সাময়িক যাত্রাবিরতি। তবে তার যাত্রা যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। প্রথমে তাকে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে রাখা হলেও পরে তাকে দিল্লির এক গোপন স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। ভারত সরকার সেই সময় এই অবস্থান সম্পর্কে কোনো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি।
শেখ হাসিনার চলাচলও সীমিত করা হয়েছে। তাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়ার ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব কম প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও তার কিছু ব্যক্তিগত যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে, তবে বড় ধরনের জনসম্মুখে তার উপস্থিতি পরিহার করা হচ্ছে। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও সীমিত রাখা হয়েছে। ভারত সরকার তাকে কোনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক বিবৃতি না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে।
তবে ভারতে থাকার সময় শেখ হাসিনার বেশ কিছু পুরনো পরিচিতজনের সাথে তার যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কন্যা শর্মিষ্ঠা মুখার্জি অন্যতম। শর্মিষ্ঠা নিজে টুইট করে শেখ হাসিনাকে তার সমর্থন জানিয়েছেন, যা তার এবং হাসিনার মধ্যে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের পরিচায়ক।
ভারতের রাজনৈতিক অবস্থান
ভারত সরকার এই ১০০ দিনে কখনোই প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ভারত জানে, শেখ হাসিনার বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসা, অন্তত এই মুহূর্তে, অত্যন্ত কঠিন। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ তার ভেতরে অস্থিরতা এবং বিভক্তির শিকার, তাই শেখ হাসিনার পুনর্বাসন প্রায় অসম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে, শেখ হাসিনার ফিরে আসা এবং রাজনীতি করার সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ করা হয়নি। একাধিক ভারতীয় কর্মকর্তার মতে— পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূল হলে, তিনি হয়তো দেশের রাজনীতিতে ফিরে আসবেন, তবে তা সময়সাপেক্ষ হবে।
ভারতের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার জন্য যা কিছু করা হচ্ছে, তা খুবই তৎপর এবং প্রমিত। গোপনীয়তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যাতে তার অবস্থান নিয়ে কোনো সমস্যা না হয়। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভূমিকা বা তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে ভারত কোনোরকম তাড়াহুড়ো করছে না। ভারতে থাকাকালীন শেখ হাসিনার যাত্রা অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত এবং সুরক্ষিত।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কতটা অবাধ?
গত মাস তিনে, শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ফোনালাপের বেশকিছু অডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যা নিয়ে দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
ভারত সরকার অবশ্য এই “ফাঁস হওয়া” অডিও সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে দিল্লির একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যারা এই বিষয়ে অবগত, ব্যক্তিগত আলোচনায় নিশ্চিত করেছেন, এসব অডিওতে শোনা কণ্ঠ আসলে শেখ হাসিনারই। এক কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, “এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব তৈরি করা হয়েছে কিনা জানি না, তবে শেখ হাসিনার পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলায় কোনো বিধিনিষেধ নেই। যদি কেউ সে আলাপ রেকর্ড করে লিক করে দেয়, আমাদের কিছু করার নেই।”
ভারতের কিছু পর্যবেক্ষক মনে করছেন, এসব আলাপ যাতে শীঘ্রই জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারে, তার জন্য হয়তো ভারতই সেগুলো ফাঁস করার সুযোগ সৃষ্টি করছে। তবে বাস্তবতা হলো, শেখ হাসিনা ভারতে গৃহবন্দি নন। তিনি এখনো নিজের দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন এবং তার ছেলে-মেয়ে, সাইমা ওয়াজেদ ও সজীব ওয়াজেদের সঙ্গেও প্রায়ই কথা বলেন। তিনি সংবাদপত্র, টেলিভিশন এবং ইন্টারনেটেও পূর্ণ অ্যাকসেস পাচ্ছেন।
ভারত সরকার শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ সীমিত রাখার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে, তাকে ভারতের মাটিতে রাজনৈতিক বিবৃতি না দেওয়ার জন্য একাধিকবার অনুরোধ করা হয়েছে। ভারতের এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হলো— তারা চায় না, কেউ এই ধারণা পোষণ করুক যে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা মনে করেন, শেখ হাসিনা যদি দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরতে চান, তবে তা অত্যন্ত কঠিন হবে, কারণ বর্তমানে দলটির ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা এবং বিভাজন রয়েছে। ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, “শেখ হাসিনার বয়স যদি দশ বছর কম হতো, তাহলে হয়তো দেশে ফিরে আসা সম্ভব ছিল, তবে এখন এটা প্রায় অসম্ভব।”
এদিকে, ফাঁস হওয়া এক অডিওতে শেখ হাসিনার মতো কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল, “আমি খুব কাছাকাছিই আছি, যাতে চট করে ঢকে পড়তে পারি।” কিছু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ধারণা করছেন, শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু ভারতের অবস্থান হলো, তারা এখনই কোনো আগ্রহী পদক্ষেপ নিতে চাইছে না।
ভারতের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, “এখন সময়টা প্রতিকূল, বল এখন উল্টোপাল্টা লাফাচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। তাই এখন ধৈর্য্যের প্রয়োজন, আর প্রতিপক্ষের ভুল সুযোগের জন্য অপেক্ষা করাই ভালো।”
এমন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনাও সম্ভবত জানেন, উপযুক্ত সময় এলেই তিনি কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেবেন। আপাতত, ভারতও এই পরিস্থিতির প্রতি খুবই সতর্ক এবং একশো দিন পরেও তাদের ভাবনা সীমিত রেখেছে। শেষ পর্যন্ত, ভারতের ভূখণ্ডে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি এখনো স্পষ্ট নয়, তবে তিনি যেকোনো রাজনৈতিক বিবৃতির মাধ্যমে পরিস্থিতি বদলানোর সুযোগ পাচ্ছেন না, তা বেশ নিশ্চিত। সূত্র: বিবিসি