আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছেন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে পরাজয়ও বরণ করতে পারেন।
দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অনেক দল এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তবে, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহিত করেছে আওয়ামী লীগ। এ কারণে অন্যান্য আসনের মতো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের আসনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্য সব নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ছাড়া অন্যান্য প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলে শাস্তির মুখোমুখি হতেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এবারের চিত্র ভিন্ন। স্থানীয় নেতাকর্মীরাও বাধাহীনভাবে যে যার পক্ষে কাজ করছেন। এ কারণে সুবিধা পাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
দীপু মনি-শামছুল হক ভূঁইয়া
চাঁদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে ছাড় দিতে নারাজ স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য শামছুল হক ভূঁইয়া। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের নির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঈগল প্রতীকে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দুজন প্রার্থীই নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার অংশ হিসেবে এলাকায় গণসংযোগ ও উঠান বৈঠক করছেন। ড. শামছুল হক ভূঁইয়া মনে করেন, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উদাহরণ হিসেবে এবারের নির্বাচন সবার মনে জায়গা করে নেবে। কাজেই সবাই ভোটকেন্দ্রে এসে তাকে ভোট দেবেন।
অন্যদিকে, গণসংযোগ ও উঠান বৈঠকে ভোটারদের উদ্দেশ্যে ডা. দীপু মনি বলেন, ভোট দেওয়াটা নাগরিক অধিকার এবং কর্তব্যও বটে। তার প্রশ্ন, যদি ১৫ বছর ভালো কাজ করে থাকি এবং খারাপ কাজ যদি না করে থাকি, তাহলে নির্বাচনে কম নম্বরে পাস করব কেন? বেশি নম্বর পেয়েই পাস করব।
দস্তগীর গাজী-শাহজাহান ভূঁইয়া
নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী আবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তিনবারের উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া।
দলীয় ও স্বতন্ত্র দুই প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণায় পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশ, শোডাউনে সরগরম নির্বাচনী এলাকা। পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানেও নির্বাচনী হাওয়া বইছে।
গোলাম দস্তগীর গাজী বলেছেন, আমি ১৫ বছর ধরে রূপগঞ্জের উন্নয়ন করে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস জনগণ আমাকে নয় উন্নয়নকে ভোট দেবে। নতুন যাকেই চাইবে তাকেই ভোট দেবে। নির্বাচন নিয়ে আমরা কোনো আশঙ্কা প্রকাশ করছি না। আমরা চাচ্ছি সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন আরও উৎসবমুখর হোক। আমরা সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। তাই এখানে কোনো শঙ্কা নেই।
স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়া বলেন, নির্বাচনে আমার প্রার্থী হওয়ার একটি কারণ, রূপগঞ্জের নির্যাতিত জনগণের পাশে থাকা। আমরা তাদের দখল করা জমি উদ্ধার করতে চাই। আমি নির্বাচিত হলে রূপগঞ্জে অস্ত্র ও মাদক নির্মূলে কাজ করব। রূপগঞ্জের জনগণ আমার সঙ্গে আছে।
নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন-সাইফুল ইসলাম খান বীরু
নরসিংদী-৪ আসনে এবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন মনোহরদী উপজেলার পাঁচবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরু।
সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই প্রার্থী আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট চাচ্ছেন। তাদের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সাধন চন্দ্র মজুমদার-খালেকুজ্জামান তোতা
নওগাঁ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নিয়ামতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য খালেকুজ্জামান তোতা। তিনি চন্দননগর ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। এ ছাড়া, তিনি নিয়ামতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি।
নুরুজ্জামান আহমেদ-সিরাজুল হক
লালমনিরহাট-২ আসনে নির্বাচন করছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও আদিতমারী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল হক।
স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল হকের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে বক্তব্য দিয়েছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুজ্জামান আহমেদের ছোট ভাই মাহবুবুজ্জামান আহমেদ। মাহবুবুজ্জামান আহমেদ কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
আ ক ম মোজাম্মেল হক-রেজাউল করিম রাসেল
গাজীপুর-১ আসনে টানা চতুর্থবারের মতো দলীয় প্রতীক নৌকা পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাক মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাসেল।
জানা গেছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম রাসেলের বড় শক্তি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। গাজীপুর মহানগরীর ১৮টি ওয়ার্ড রয়েছে আসনটিতে। মহানগরীর ওই এলাকাগুলোতে জাহাঙ্গীর আলমের আধিপত্য রয়েছে। যার কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাসেলের জন্য আশীর্বাদ জাহাঙ্গীর। এ আসনে রাসেলকে বিজয়ী করতে মাঠে নেমেছেন জাহাঙ্গীর আলম ও তার সমর্থকরা।
জাহিদ আহসান রাসেল-কাজী আলিম উদ্দিন
গাজীপুর-২ আসনে নৌকার মাঝি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। আসনটিতে আওয়ামী লীগের আরও দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। একজন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলিম উদ্দিন, অপরজন গাজীপুর মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম।
এর মধ্যে কাজী আলিম উদ্দিনের পক্ষে কাজ করছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। দুই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হয়ে জাহাঙ্গীরের প্রচারণার ফলে গাজীপুরে তৈরি হয়েছে ভোটের নতুন সমীকরণ।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষ নেওয়ার বিষয়ে গত ১৮ ডিসেম্বর নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, প্রত্যেকে নির্বাচন করতে পারবেন। কোনো প্রার্থী যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে না পারেন। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনকে একটা সুন্দর ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন উপহার দিতে চাই। সে লক্ষ্যে আমরা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। এটাকে যেন কেউ ভুলভাবে ব্যাখ্যা না দেন। আমাদের প্রত্যেকের রক্তে আওয়ামী লীগ। আমরা জন্মগতভাবে আওয়ামী লীগ করি।
এনামুর রহমান-মুরাদ জং
ঢাকা-১৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং ওরফে মুরাদ ও আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই প্রার্থীর কারণে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়েছেন প্রতিমন্ত্রী এনামুর। শেষ পর্যন্ত ফলাফল কী হয়, জানা যাবে ৭ জানুয়ারি।
শাহরিয়ার আলম-রাহেনুল হক
রাজশাহী-৬ আসনে টানা চতুর্থবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা রাহেনুল হক রায়হান। এ আসনে ১৯৯৯ এর উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দলের একটি অংশের নেতাকর্মীরা রাহেনুল হকের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। এ নির্বাচনে শাহরিয়ারের সঙ্গে রাহেনুলের শক্ত লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
মাহবুব আলী-ব্যারিস্টার সুমন
হবিগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক যুবলীগ নেতা ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় আছেন ব্যারিস্টার সুমন। তিনি ঈগল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকে এ দুই প্রার্থী ও তাদের কর্মীরা গ্রামে-গ্রামে ঘুরে সাধারণ ভোটারদের নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছেন। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তাদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ফরহাদ হোসেন-আব্দুল মান্নান
মেহেরপুর-১ আসনে আবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। নৌকা প্রতীকের এ প্রার্থীর বিরুদ্ধে ট্রাক প্রতীক নিয়ে লড়তে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন দুবারের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। দলের আরেক সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদিনও রয়েছেন এ দৌড়ে। তবে, ফরহাদ হোসেন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নানকে বেশি সক্রিয় দেখা যাচ্ছে।
স্থানীয়রা বলছেন, নির্বাচনে ফরহাদের সঙ্গে আব্দুল মান্নানের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
জুনাইদ আহমেদ পলক-শফিকুল ইসলাম শফিক
নাটোর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নৌকা এবং সদ্য পদত্যাগকারী সিংড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফিকের ঈগল প্রতীকের লড়াই জমজমাট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দৃশ্যমান উন্নয়ন ও বেকারদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতের জন্য হাইটেক পার্ক করার জন্য নতুন ও তরুণদের ভোট টানবেন পলক। অপরদিকে, ১৫ বছরে সুবিধা ও দলের পদবঞ্চিতদের ভোট টানবেন শফিক— এমনটাই আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, গত ১৫ বছর নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনের মানুষ যে উন্নয়ন, সেবা ও সুশাসন পেয়েছে; সেই নৌকার প্রতি আস্থা ও সমর্থন আবারও তারা ব্যক্ত করবেন। আগামী ৭ জানুয়ারি নাটোর-৩ আসন থেকে বিপুল পরিমাণ ভোট নৌকা মার্কায় দিয়ে সিংড়াবাসী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন।
শফিকুল ইসলাম শফিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিংড়ার জনগণের ভালোবাসায় একবার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, দুবার উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে প্রায় ১৫ বছর দায়িত্ব পালন করেছি। সিংড়ার জনগণের দাবির মুখে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। আশা করছি, এবার বঞ্চিত মানুষের আশার প্রতিফলন ঘটবে। জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখব।