রাশিয়া ও ইউক্রেনগম আমদানির বাংলাদেশে বড় উৎস । দেশ দুটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও গম আমদানির উৎস নিয়ে তৈরি হয় সংকট। এর মধ্যে আরেক বড় রপ্তানিকারক দেশ ভারত গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়। বাংলাদেশ সেই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকার পরও অস্থির হয়ে ওঠে গমের বাজার। দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। একই সঙ্গে দাম বেড়েছে গমজাত সব পণ্যেরও। কিন্তু ভারত, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে ছয়টি গমবাহী জাহাজ গত কয়েক দিনে বন্দরে ভেড়ায় কিছুটা কমতে শুরু করেছে গমের দাম।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, সরকারিভাবে আমদানি হচ্ছে এক লাখ পাঁচ হাজার টন গম। এর মধ্যে ৫২ হাজার পাঁচশ টনের একটি জাহাজ থেকে গম খালাস চলছে। সোমবার (২৩ মে) রাতে আরেকটি জাহাজ থেকে খালাস শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর।
খাদ্য বিভাগ ও চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, ভারতের গুজরাটের কন্দলা বন্দর থেকে ‘এমভি ভি স্টার’ নামে একটি জাহাজ সরকারি ৫২ হাজার পাঁচশ টন গম নিয়ে আসে। চালানটি রোববার (২২ মে) চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। সোমবার (২৩ মে) রাতে জাহাজটি থেকে গম খালাসের প্রস্তুতি নিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। এর আগে গত ১৬ মে ভারত থেকে আসা ৫২ হাজার পাঁচশ টন সরকারি গমের আরেকটি চালান নিয়ে আসে ‘এমভি ইমানুয়েল সি’। বর্তমানে জাহাজটি থেকে গম খালাস নিচ্ছে খাদ্য অধিদপ্তর। জাহাজটি থেকে ৩১ হাজার পাঁচশ টন খালাস হবে চট্টগ্রাম বন্দরে। মোংলা বন্দরে খালাস হবে অবশিষ্ট ২১ হাজার টন গম।
চট্টগ্রাম খাদ্য চলাচল ও সংরক্ষণ কার্যালয়ের সহকারী নিয়ন্ত্রক সুনীল দত্ত জাগো নিউজকে বলেন, এখন চট্টগ্রাম বন্দরে সরকারি গম নিয়ে আসা দুটি জাহাজ রয়েছে। দুটি জাহাজই এসেছে ভারত থেকে। এর মধ্যে গত ১৬ মে আসা ‘এমভি ইমানুয়েল সি’ জাহাজ থেকে গম খালাস চলছে। জাহাজটির অবশিষ্ট ২১ হাজার টন গম মোংলা বন্দরে আনলোড হবে। বুধবারের মধ্যে এটি মোংলায় চলে যেতে পারে। রোববার (২২ মে) আসা জাহাজটি সোমবার কাস্টম থেকে শুল্কায়ন হলে রাত থেকেই খালাস শুরু করা হবে।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া বেসরকারি আমদানিকারকদের জন্য ভারত, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে নিয়ে আসা চারটি গমবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করছে। এর মধ্যে ভারতের কন্দলা বন্দর থেকে ‘এমভি প্রোপেল গ্রেস’ ৫৯ হাজার আটশ টন গম নিয়ে এসেছে। গত ৯ মে ওই জাহাজটি থেকে গম খালাস শুরু হয়। রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ গমের চালানটি আমদানি করেছে বলে জানা গেছে। একইভাবে ৫৮ হাজার পাঁচশ টন গমের চালান নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে এমভি সামার স্কাই। এই জাহাজ থেকেও গম খালাস শুরু করেছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নাবিল গ্রুপ।
গত ১৬ মে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসে ‘এমভি থর ম্যাক্সিমাস’। অস্ট্রেলিয়ার জিলং বন্দর থেকে ৪৭ হাজার পাঁচশ টন গম নিয়ে আসে জাহাজটি। আরেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিসমিল্লাহ গ্রুপ এ চালানটি আমদানি করে। এছাড়া ৬০ হাজার ৩৭৫ টন গম নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে ‘এমভি এইপিওএস’। কানাডার ভ্যানকুভার বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে জাহাজটি। চালানটি কারা আমদানি করছে জানা যায়নি।
খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি (২০২১-২২) অর্থবছরের প্রথম সাড়ে ১০ মাসে (১ জুলাই ১৫ মে পর্যন্ত) সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মোট ৪৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৯০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ৯ লাখ ৮২ হাজার ৭০০ টন চাল এবং ৩৪ লাখ ৭ হাজার ৭৯০ মেট্রিক টন গম। একই সময়ে সরকারিভাবে খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৬৭০ মেট্রিক টন। এতে চাল আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৪০ মেট্রিক টন এবং গম আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৪১ হাজার ৬৩০ মেট্রিক টন। নতুন করে ভারত থেকে আসা দুই জাহাজে সরকারি এক লাখ ৫ হাজার টনের গম যুক্ত হলে সরকারিভাবে গমের মজুত বাড়বে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত সাড়ে ১০ মাসে খাদ্য অধিদপ্তর ৩ লাখ ২১ হাজার ১৩২ টন গম আমদানি করেছে। একই সময়ে বেসরকারি আমদানিকারকরা ১৩ লাখ ৭২ হাজার ২৬৮ টন গম খালাস নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে।
এদিকে, ভারত গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির পর দেশের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। এর প্রভাব পড়ে পাইকারি বাজার থেকে শুরু করে তৈরি খাদ্যপণ্যের দামেও। তবে গমের আমদানি স্বাভাবিক হওয়ায় বাজারেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে খাতুনগঞ্জের বাজারে প্রতি মণে ৫০ থেকে ৭০ টাকা কমেছে গমের দাম।
খাতুনগঞ্জের গম ব্যবসায়ী আবু তৈয়্যব জাগো নিউজকে বলেন, ভারতের নিষেধাজ্ঞার পর খাতুনগঞ্জে হঠাৎ করে গমের দাম বেড়ে যায়। ঈদের পরের সপ্তাহে মণপ্রতি ভারতীয় গম এক হাজার ৪৮০ থেকে এক হাজার ৪৯০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এখন মণে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কমেছে। রোববার মণপ্রতি এক হাজার ৪১০ টাকায় গমের ডিও বিক্রি হয়েছে। তবে রেডি (কারখানা থেকে তাৎক্ষণিক সরবরাহযোগ্য) গমের দাম একটু বেশি।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ডলারের দাম হু হু করে বাড়ছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের দরের চেয়ে খোলা মার্কেটে ডলারের দাম অনেক বেশি। যে কারণে অনেক ব্যাংক এলসি (ঋণপত্র) খুলতে চাইছে না। এতে আমদানি পণ্যের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে। এ সমস্যা সমাধানে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রত্যেক ব্যাংকে ডলারের দাম একই রাখতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় ভারত থেকে গম আমদানি বেড়েছে। এর মধ্যে ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে খাতুনগঞ্জসহ সারাদেশে গমের দাম কিছুটা বেড়েছিল। এখন ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোতে গম রপ্তানি বন্ধ করবে না নিশ্চিত করার পর বাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরই মধ্যে ভারত থেকে বেশ কয়েকটি জাহাজ গম নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। এতে গমের দাম কমতে শুরু করেছে। আগামীতে গমের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসবে।