সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীতেও ক্ষমতাসীনরা অসন্তুষ্ট হয় এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি ইসিকে। যদিও কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটেছে।
সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিশ্চত করা আছে। এছাড়া নির্বাচন সংক্রান্ত আইন এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা স্পস্ট ও বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের মাধ্যমে।
র্মকর্তা বদলি
আব্দুল আলীম একজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেছেন, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন চাইলে আইন অনুযায়ী প্রশাসনের মধ্যে রদবদল আনতে পারেন।
অন্যদিকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বদলি করার প্রয়োজন হলে নির্বাচন কমিশন লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবে। এরপর যত দ্রুত সম্ভব সে বদলি কার্যকর করতে হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইসির চাহিদা মতো কাজ না করল সরকার আইনের বরখেলাপ করবে। সাধারণত, সরকার সবসময় তাদের পছন্দমতো কর্মকর্তাদের সেসব জায়গায় নিয়োগ করে দেয়। এটা সব সরকারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
তবে নির্বাচন কমিশনের চাহিদা উপেক্ষা করা কিংবা তাদের সাথে আলোচনা না করার নজিরও নেহায়েত কম নয়। ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গাজীপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদকে সে জেলা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়াই তাকে আবারও গাজীপুরে পুনর্বহার করা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, তিনি নির্বাচনের পরেই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন সশস্ত্র বাাহিনী বিভাগকে চিঠি দিয়েছিল নির্বাচনের দু’দিন আগে থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে। কিন্তু সেটি করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। তবে নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করা কিংবা না করা হলে সেক্ষেত্রে কমিশন কী করতে পারে?
আব্দুল আলীম বলেন, এটা নিয়ে সরাসরি আইনে কিছু বলা নেই। সংবিধানে বলা আছে নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে। কিন্তু যদি না করে বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। তার পরামর্শ, এমন কিছু ঘটলে নির্বাচন কমিশন আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে।
ভারতের একটি উদাহরণ টেনে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, যদি সরকার নির্বাচন কমিশনের কোনো অনুরোধ উপেক্ষা করে তাহলে সেখানে নির্বাচন কমিশন আদালতে চলে যায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কখনোই কোনো ইলেকশন কমিশন আদালতে যায়নি।
একই উদাহরণ দিয়ে সাবেক ইসি এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আইনের ব্যত্যয় হলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করে।
প্রার্থিতা বাতিল
পর্যবেক্ষকদের উদ্বৃতি দিয়ে আব্দুল আলীম বলেন, যদি কোনো প্রার্থী নির্বাচনী আইন ও আচরণ বিধির গুরুতর লঙ্ঘন করেন, সেক্ষেত্রে প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে ইসি। বিষয়টিতে নির্বাচন কমিশনের পুরোপরি এখতিয়ার আছে। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনো এখন পর্যন্ত নেই। সাধারণত নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনের দায়ে জরিমানা ও সতর্ক করার নজির থাকলেও প্রর্থিতা বাতিলের বিষয়টি দেখা যায় না।
রিটার্নিং অফিসারকে নিয়ন্ত্রণ করা
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে উল্লেখ করা আছে, একজন রিটার্নিং অফিসারকে নির্বাচন কমিশন যেভাবে দায়িত্ব দেবে, তিনি সে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য থাকবেন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীমের ভাষায়, একজন রিটার্নিং অফিসার একটি এলাকায় ‘অল ইন অল’ বা সর্বেসর্বা। তার তত্ত্বাবধানের নির্বাচন পরিচালিত হয়।
জেলা প্রশাসকরা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা নন। তারা যদি নির্বাচনের কমিশনের নির্দেশনা মেনে না চলেন সেক্ষেত্রে কমিশন কী করতে পারে?
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ ও বাতিল করা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তাকে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগের বিষয়টি বাতিল করতে পারে।
ফলাফল বাতিল
গত ১৯ মে গণপ্রতিনিত্ব আদেশের সংশোধনী অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। বিষয়টি নিয়ে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল- ‘নির্বাচনের পরে ফলাফল বাতিল করতে পারবে না কমিশন’। এতে নির্বাচন কমিশনের ‘ক্ষমতা খর্ব হয়েছে’ বলে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়।
তখন নির্বাচন কমিশনের সচিব গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, নির্বাচনী কার্যক্রম ও ভোট চলাকালে নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা কমিশনের হাতে আছে। যে সংশোধনী যুক্ত করা হয়েছে সেটি হচ্ছে– নির্বাচনের ফলাফল গেজেট বা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হওয়ার পরে পুরো নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করা যাবে না।
নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে, যেটি আগে পারতো না বলে নির্বাচন কমিশন দাবি করছে। তদন্তের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সঙ্গত মনে করলে যেসব কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেসব কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করতে পারবে।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে গাইবান্ধায় একটি আসনে উপ-নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে সেদিনই ভোটগ্রহণ বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের এই ক্ষমতা বহাল আছে।স0প0