দীর্ঘ ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিজাব পরিহিত হাজার হাজার নির্যাতিত শিক্ষার্থীর লড়াইকে শ্রদ্ধা জানাতে হিজাবকে ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতীক ঘোষণা করেছে বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ।
সংগঠনটি জুলাই বিপ্লবসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী সব লড়াইয়ে হিজাব পরিহিত শিক্ষার্থীদের লড়াইকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে।
এর অংশ হিসেবে হিজাব সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করে হিজাব পরিহিত শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন ও বৈষম্য করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণার দাবিও জানিয়েছে জুলাই বিপ্লবের পর গঠিত ছাত্র সংগঠনটি।
রোববার (২৫ মে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় আয়োজিত ব্যতিক্রমধর্মী ‘Celebrating Women’s Dignity and Pride 2025’ (নারীর মর্যাদা ও গৌরব উদাযাপন ২০২৫) শীর্ষক উৎসব পালনকালে এসব দাবি জানানো হয়।
উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজারেরও বেশি নিবন্ধিত নারী শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম ধাপে ৫০০ জনের হাতে সরাসরি প্রতিরোধ ও সম্ভ্রমের প্রতীক হিসেবে হিজাব তুলে দেয় বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ।
এ ছাড়া অন্য নারী শিক্ষার্থীদের চকলেট ও কলম উপহার দেওয়া হয়। সংগঠনটি জানিয়েছে দ্বিতীয় ধাপে নিবন্ধিত বাকি শিক্ষার্থীদের হিজাব দেওয়া হবে।
এদিন সকাল ১০টায় বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার আহ্বায়ক সানোয়ারা খাতুনের সভাপতিত্বে উৎসব শুরু হয়।
উৎসবের উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিজাব পরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হল থেকে বিতাড়িত ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সাবেক কেন্দ্রীয় নেত্রী মরিয়ম জামিলা তামান্না।
তিনি বলেন, গত ১৬ বছরের ফ্যসিবাদী সরকারের আমলে একটি মুসলিম দেশে বাস করেও আমরা ধর্মীয় স্বাধীনতা ও পোশাকের স্বাধীনতা পাইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায়ও আমাদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। হিজাব পরার কারণে আমাকেসহ অনেক বোনকে আবাসিক হলে থাকতে দেওয়া হয়নি। আমাদের অনেককে মারধর করার পর গভীর রাতে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য এসব ঘটনায় হিজাব বিদ্বেষী ফ্যাসিস্ট শিক্ষকরাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। আমরা শেখ হাসিনার শাসনের প্রথমভাগে ছিলাম বলে তখন আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিলেন না। তবে পরবর্তীতে হিজাব বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এই প্রতিরোধের ধারাবাহিকতায় বিপুল সংখ্যক হিজাব পরিহিত শিক্ষার্থী জুলাই বিপ্লবে সম্মুখ সারিতে ছিলেন।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমিনা তামান্না নেকাবের কারণে নিজের বৈষম্যের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসের দিনই একজন শিক্ষক আমাকে অপমান করেন। পরীক্ষার হলে এবং ভাইভা বোর্ডে আমাদেরকে বাধ্য হয়ে নিকাব খুলতে হতো। কিন্তু ফ্যাসিবাদের পতনের পরে আমি এর প্রতিবাদ করি, সংবাদ সম্মেলন করি এবং এর ফলে এতোদিন ধরে চলে আসা বৈষম্যের অবসান হয়। হিজাব, নিকাব নিয়ে কেউ কোথাও কোনো সমস্যায় পরলে হীনমন্যতা না রেখে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানান তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেত্রী নাফিসা ইসলাম সাকাফি ছাত্রীদেরকে নিজেদের অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আপনারা যদি কথা না বলেন তাহলে আমরা যারা কথা বলতে চাই তাদের জন্য জায়গাটা অনেক সংকীর্ণ হয়ে যায়। কারণ, কেউ হিজাব নেকাবের কারণে নির্যাতিত নিপীড়িত হলে আমি যখন সেটার প্রতিবাদ করতে যাই তখন অন্যরা বলে যারা হিজাব নেকাব করছে তারা তো প্রতিবাদ করে না, তুমি কেন কথা বলছো? যদি মনে করেন আমাদের অধিকারের জন্য সবসময় আমাদের ভাইয়েরাই লড়াই করবে এটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয় না।
সানোয়ারা খাতুন বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে জেঁকে বসা ইসলামোফোবিয়া বা মুসলিম নারীদের নিষ্পেষণের যে একটা চলমান সংকট ছিল সেখান থেকে উত্তরণের মাধ্যম ছিল জুলাই-আগস্টের বিপ্লব, সে বিপ্লবে আমাদের নারীদের উপস্থিতি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও ঐতিহাসিক। সে ধারাবাহিকতাকে প্রমোট করার উদ্দেশ্যে আমাদের আজকের এই আয়োজন।
প্রোটেস্ট অ্যাগেইনস্ট হিজাবফোবিয়া ইন ডিইউ এর সদস্য হাবিবা মাহজাবিন জ্যোতি বলেন পর্দা মুসলিম নারীর আইডেন্টিটি। কিন্তু এটাকে জঙ্গিবাদের প্রতীক হিসেবে চিত্রায়িত করে সর্বত্র হিজাবের বিরুদ্ধে একটা ফোবিয়া তৈরি করা হয়েছে। আমরা এটা সমাধানের জন্য এবং আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
অনুষ্ঠানে নারীর প্রতি বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়। এতে ভর্তি, একাডেমিক ও নিয়োগ পরীক্ষা ও ভাইভায় নিকাব পরিহিত ছাত্রীদের ফিংগারপ্রিন্টের মাধ্যমে পরিচয় সনাক্ত করণের আহ্বান জানানো হয়।
এ ছাড়া বলা হয়, ইসলামে নারীকে যে উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছে তার আলোকে রাষ্ট্রের কাছে পুরুষের চেয়ে নারীর বেশি অধিকার প্রাপ্য। ফলে রাষ্ট্রকে নারীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিশেষ বৃত্তি ও বিনা সুদে শিক্ষাঋণ, বিনামূল্যে চিকিৎসা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, নারীবান্ধব গণপরিবহণে যাতায়াত, সম্পত্তিতে ইসলাম প্রদত্ত অধিকার বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাবা-ভাই-স্বামীর কাছ থেকে সম্পত্তি উপহারের সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।
উৎসবে নারী অতিথিদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন বিপ্লবী নারী পরিষদের সহকারী সদস্য সচিব অবনি আক্তার ও সুচি কুমকুম তৃপ্তি, কেন্দ্রীয় সদস্য তাহমিনা বেগম এবং ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের মুখপাত্র শাহরিন ইরা প্রমুখ।
দিনব্যাপী আয়োজনে হিজাবোফোবিয়া তথা হিজাব বিদ্বেষের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা দিনভর তাদের অনুভূতির কথা তুলে ধরেন। তারা লেখেন ‘হিজাব হোক প্রতিরোধের প্রতীক’, ‘একমাত্র হিজাবই নারীর সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতীক’ ‘হিজাব হীনমন্যতার প্রতীক নয়, বরং মুসলিম আত্মপরিচয় রক্ষায় হিজাব আমার দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রতীক’ ‘আমার সোনার বাংলায় হিজাব বৈষম্যের ঠাই নয়’।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জি এ গাউস, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমির শায়খুল হাদিস আহমদ আলী কাসেমী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. বেলাল হোসাইন, ইসলামী লেখক ও গবেষক মূসা আল-হাফিজ, ওয়ার্ল্ড মুসলিম উম্মাহর সভাপতি ডা. ফরিদ উদ্দীন আহমদ খান, জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দীন, যুগ্ম আহ্বায়ক সাইয়েদ কুতুব ও সহকারী সদস্য সচিব গুলবুদ্দীন গালীব ইহসান, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি, জুলাই ঐক্যের সংগঠক এবি যোবায়ের, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মোহাম্মদ আলাউদ্দীন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সংগঠক সানাউল্লাহ খান।