আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ঢাকা-৫ আসন। ২০০৮ থেকে এ আসন নিজেদের দখলে রেখেছে দলটি। যদিও আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন এ আসনের স্থানীয় নেতারা। এ বিভক্তির জন্য বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনুকে দায়ী করছেন অনেক নেতাকর্মী। অভিযোগ অস্বীকার করে এবারও মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন মনু।
স্থানীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে কাজী মনিরুল ইসলাম মনুর সঙ্গে তাদের দূরত্ব বেড়ে গেছে। সংসদীয় আসনটির এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে চাঁদাবাজ ও বালি ভরাট করে জমি দখলের মতো অপরাধগুলো হচ্ছে না। এসব অপকর্মের সঙ্গে বর্তমান এমপির লোকজন জড়িত বলে অন্য নেতাকর্মীদের অভিযোগ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নতুন কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে তারা।
চাাঁদাবাজি ও জমি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেননি এমপি মনুও। তার দাবি, বাইরের লোকজন তার নাম ভাঙিয়ে এসব অপকর্ম করছে।
ঢাকা জেলার অন্তর্গত এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪৮, ৪৯, ৫০, ৬০, ৬১, ৬২, ৬৪, ৬৫, ৬৬, ৬৭, ৬৮, ৬৯ ও ৭০ নং ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসন। এ আসনে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৭১ হাজার ১২৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৬৪ জন আর নারী ভোটার ২ লাখ ২৯ হাজার ৬৬৫ জন। এ আসনটি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জন্য রাজধানীর প্রবেশমুখ হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৬ মে ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান মোল্লা মৃত্যুবরণ করেন। ওই বছরই এ আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনু। নির্বাচনে ভোট পড়ে শতকরা ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ নির্বাচনের পর থেকে ঢাকা-৫ আসনে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যান। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এখনও অনেক গ্রুপে বিভক্ত। এ বিভক্তির জন্য বর্তমান সংসদ সদস্যের সঙ্গে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দূরত্বকে দায়ী করছেন স্থানীয় নেতাদের অনেকে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই আসনে নৌকার টিকিট চান হাফ ডজন নেতা। তাদের মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনুও রয়েছেন। এছাড়া আলোচনায় রয়েছেন প্রয়াত হাবিবুর রহমান মোল্লার বড় ছেলে মশিউর রহমান মোল্লা সজল, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি কামরুল হাসান রিপন, যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুনর রশিদ মুন্না, ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম খান মাসুদ, ৭০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আতিকুর রহমান আতিক, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সাবেক সদস্য ও শহীদ শেখ কামালের স্ত্রী শহীদ সুলতানা কামালের ভাতিজি নেহরীন মোস্তফা দিশি, ১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মো. শহীদুল ইসলাম প্রমুখ।
জানতে চাইলে বর্তমান সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম মনু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার দায়িত্বপালনের ২ বছর তিন মাস চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন চিত্র নাগরিকদের সামনে তুলে ধরছি। এলাকার মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করছি। জনগণই বলতে পারে আমি কতটুকু খারাপ আর কতটুকু ভালো করেছি। দলের নেতাদের সঙ্গে আমার দূরত্ব বাড়েনি। অনেকে মনে কষ্ট নিয়ে হয়ত বলতে পারেন আমাকে এই দিল না, সেই দিল না। আমরা কী দিতে পারি? দূরত্ব বলতে এমন নয় যে আমি তাদের নিয়ে মিছিল করি না। আমি তাদের নিয়ে মিছিল করি, দলের সকল প্রোগ্রামে যাই। দূরত্ব কীভাবে হলো আমি জানি না। আমি নেতাকর্মীদের সঙ্গে আছি, থাকব।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো। এখানে কর্মীদের মধ্যে কোনো মারামারি নেই। দলে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে, পৃথিবীর সবখানেই এটা আছে। আমাদের এখানে মারামারি, ধরাধরি, অমুক-তমুক, এটা সেটা, এগুলো নেই। আমার এই দুই থানার নেতাকর্মীদের সঙ্গে অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক আছে।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা বলেন, ঢাকা-৫ আসনটি আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। কিন্তু আসনটিতে সাংগঠনিক গ্রুপ অনেক বেশি। অন্তত চার ভাগে বিভক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনদের গ্রুপিংয়ের খেসারত দিতে হয় স্থানীয়দের। এখানে দলীয় ব্যানারে চাঁদাবাজি হচ্ছে বলেও জানান ভুক্তভোগীরা। স্থানীয় এমপির নামে প্রতিটি বাস স্টেশন, সিএনজি স্টেশন ও ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া বালু ভরাটের নামে স্থানীয়দের জিম্মি করে চাঁদা আদায় হচ্ছে অহরহ।
এ প্রসঙ্গে বর্তমান সংসদ সদস্য বলেন, আমার এলাকার মধ্যে চাঁদাবাজির বিষয়ে আপনি যেটা বললেন সেটা ৮০ ভাগ সত্য। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন উপায়ে চাঁদাবাজি হচ্ছে। বাস-টেম্পো স্টেশন, এটা-সেটা সমানে চাঁদাবাজি হচ্ছে। এটা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। ভ্যান গাড়ি নিয়ে গেলেও নাকি চাঁদা দিতে হয়, সব জায়গায় একই অবস্থা। এসব চাঁদাবাজি কারা করে সেটা আমি জানি না। প্রশাসনকে এ ব্যাপারে শক্ত হওয়া উচিত।
জনপ্রতিনিধি হিসেবে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে না পারার বিষয়টি কি আপনার ব্যর্থতা প্রমাণ করে না? এমন প্রশ্নের জবাবে এ সংসদ সদস্য বলেন, আপনি যদি মনে করেন ব্যর্থতা, তাহলে তাই। প্রশাসন যদি শক্ত হয় তাহলে আমরা আরও শক্ত হতে পারি। আমরা বুঝতেই পারি না কে বা কারা এগুলো করছে। যারা চাঁদাবাজি, ধান্দাবাজি করে তাদের হুঁশিয়ার করে আমি কয়েক বার ফেসবুকে বলেছি, আমি পুলিশ প্রশাসনকেও বলেছি। আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন, আমার ভাই, আমার নিজের ছেলেও যদি করে তাহলেও তাদের ছাড়বেন না। আমার ভাইদের কেউ চেনে না, আমার ছেলেও এগুলোর মধ্যে নেই। আমার ৫টা ভাই, তাদের কেউ চেনে না। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল আমার নাম ভাঙিয়ে এগুলো করে। আমি তাদের চিনিও না। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে একমাত্র পুলিশ প্রশাসন। তাদের হস্তক্ষেপ ছাড়া এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী মশিউর রহমান মোল্লা সজল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গণসংযোগ শুরু করে দিয়েছি। বিভিন্ন ওয়ার্ডে যাচ্ছি, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলছি। চলার পথে সবার সাথে কুশল বিনিময় করছি। এলাকার মুরব্বীদের সঙ্গে কথা বলছি, তাদের থেকে দোয়া নিচ্ছি। এছাড়া আওয়ামী লীগ বা দল থেকে যেসব নির্দেশনা আসছে সে অনুযায়ী কাজ চলছে।
তিনি বলেন, দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয় এবং জনগণ যদি আমাকে ভোটে জয়যুক্ত করে, তবে বর্তমানে যে অনিয়মগুলো চলছে তা বন্ধ হয়ে যাবে। এখানে চাঁদাবাজি, মাদক, জমি দখল, অবৈধ বালি ব্যবসার সমস্যা প্রকট। আমি চেষ্টা করব এসব সমস্যা দূর করতে। সবচেয়ে যে বড় বিষয় হচ্ছে, দলীয় শৃঙ্খলা বা চেইন অব কমান্ড। উপনির্বাচনের পর এটি একদমই ভেঙে গেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো চেইন অব কমান্ড নেই। ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেউ কাজ করছে না। বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করলেও সেটা নিয়ে আমার কথা নয়। তবে বড় কোনো কর্মসূচিতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছি না। একটা পক্ষ আমরা রাস্তায় থাকছি, আরেকটা পক্ষ রাস্তায় নেই।
মনোনয়ন প্রত্যাশী আরেক নেতা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি কামরুল ইসলাম রিপন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ আসনের প্রত্যেকের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে যাচ্ছি। এই আসনটি হলো ঢাকার এন্ট্রি পয়েন্ট। এখানে জামায়াত-বিএনপির অবস্থানের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলন করে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমি আগে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি। এখন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। হেফাজত, জামায়াত-বিএনপির সকল কর্মসূচি প্রতিহত করতে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা আমার নেতাকর্মীরা দখলে রেখেছিল, সেটা এখনও দখলেই আছে। যুব সমাজ আমার সঙ্গে কাজ করে। করোনাকালীন সময়ে আমি প্রত্যেক ঘরে ঘরে গিয়েছি। এই ঈদে শেখ হাসিনার নির্দেশে কয়েক হাজার পরিবারকে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী বিতরণ করেছি।
যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুনর রশিদ মুন্না ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে ছাত্র রাজনীতি করছি। ৯২ সালে থানা আওয়ামী লীগের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ৯৮ সালে সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ২০০৪ সালে কাজী মনু সভাপতি, আমি সাধারণ সম্পাদক (অবিভক্ত ডেমরা), ২০১৬ সালে কাজী মনু সভাপতি আমি সাধারণ সম্পাদক। লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলন, ত্যাগ, পরিশ্রম কম করিনি। ২০০৮ সালে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। দলের প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি এবার আমার হক, আমার নেতাকর্মীদের হক।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একটা বড় দল। ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায়, গ্রুপিং থাকবে না, এটা কি হয়? গ্রুপিং অবশ্যই থাকবে। এক সময় হাবিবুর রহমান মোল্লা ও আমি এককভাবে নেতৃত্ব দিয়েছি, হাবিবুর রহমান মোল্লা এমপি হওয়ার পর থেকে তিনি তার মতো, আমি আমার মতো। আমি ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচন পরিচালনা করেছি।
আরেক প্রার্থী আতিকুর রহমান বলেন, আমি ৭০ নং ওয়ার্ডে বিপুলভাবে নির্বাচিত দুইবারের বিজয়ী জনপ্রতিনিধি। সফল এবং সার্থকভাবে আমি আমার প্রতিনিধিত্ব করছি। আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য নেত্রী আমাকেই দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করবেন বলে আমি আশা করছি।
তিনি বলেন, এ আসনটিকে সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগের আসন হিসেবে রূপান্তরিত করে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে চাই। আমার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী যাকেই মনোনয়ন দেন আমরা সকলে তার পক্ষে কাজ করব। আমাকে বা যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক, শেখ হাসিনার প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য সবাই মাঠে কাজ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।