ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির যাঁদের বিরুদ্ধে সমিতির ১৭৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ, তাঁদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির টাকা আত্মসাতের বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলায় দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
রোববার (৮ মে) ঢাকা ওয়াসার সচিব শারমিন হক আমীর স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয়, শহিদুল কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে গণমাধ্যমে ঢাকা ওয়াসা সম্পর্কে বিরূপ ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর এই কার্যকলাপের কারণে ঢাকা ওয়াসার ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। গণমাধ্যমে তাঁর কথা বলা অফিস শৃঙ্খলা পরিপন্থি ও গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধের সামিল বলে বরখাস্তের আদেশে উল্লেখ করা হয়।
তাতে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার চাকরি প্রবিধানমালা অনুযায়ী, এটি আওতাভুক্ত অপরাধ। তাই জনস্বার্থে তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। শাহাব উদ্দিন সরকারকে দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও অসদাচরণের অভিযোগে গত ১৫ মার্চ স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করেছে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। অথচ ওয়াসার হাজিরা নথি অনুযায়ী, শাহাব উদ্দিন সরকার ২০ মার্চ পর্যন্ত অফিস করে অবসরে গেছেন। তিনি এপ্রিল মাসেও খোরাকি ভাতা পেয়েছেন।
সমিতির নেতারা বলছেন, গণমাধ্যমে কথা বলায় শাহাব উদ্দিনকে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু তারিখ দেখানো হয়েছে মার্চ মাসের। জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকা ওয়াসার কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির ১৭৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্তরা বিভিন্ন সময় সমিতির শীর্ষ পদে ছিলেন। সমবায় অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।
অর্থ-আত্মসাতের বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির ওপর এ নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে ২০২১ সালের জুন মাসে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সমবায় অধিদপ্তর ও ঢাকা ওয়াসাকে দেওয়া হয়। এতে আর্থিক অনিয়ম নিয়ে অধিকতর তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যদিও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সমিতির অর্থ-আত্মসাতের বিষয়ে শহিদুল ইসলাম ও শাহাব উদ্দিন সরকার সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে কথা বলেন। শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ওই টেলিভিশনে ঢাকা ওয়াসার বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দিইনি। প্রায় দেড় বছরেও সমিতির নামে থাকা ব্যাংক হিসাবের সিগনেটরি পরিবর্তন না করায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। এখানে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের ভাবমূর্তি ও সুনাম কোথায় ক্ষুণ্ন হয়েছে বুঝতে পারছি না। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরোটলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী বলেই সমিতির সহ সভাপতি হিসেবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছি। এখানে ওয়াসার কর্মচারী পরিচয়ে কথা বলিনি। ’
এ বিষয়ে শাহাব উদ্দিন বলেন, ঢাকা ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে সমিতির টাকা সরানো হয়েছে। জড়িত ব্যক্তিরা ওয়াসা প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ বলেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বরং যাঁরা অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপ প্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক বলেন, এ বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসা কমিশন বাবদ প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা সমিতির ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়েছে। অথচ সমিতির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে জমা দেখানো হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। বাকি প্রায় ১৩২ কোটি টাকার কোনো হিসাব নিরীক্ষা দল পায়নি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যে সমিতির ব্যাংক হিসাব থেকে ৪৪ কোটি ২১ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। এই টাকা ব্যয়ের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।
ঢাকা ওয়াসার বর্তমান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামান ছিলেন কর্মচারী সমিতির বিগত কমিটির সভাপতি ও বিল আদায় কার্যক্রমের অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান। ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব পরিদর্শক জাকির হোসেন ছিলেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আর অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে থাকা ওয়াসার রাজস্ব পরিদর্শক মিয়া মো. মিজানুর রহমান ছিলেন বিল আদায় কার্যক্রমের কো-চেয়ারম্যান।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের কমিটি দায়িত্বে থাকার সময় অর্থ-আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা দলের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির বিপুল আয়ের উৎস গ্রাহকের বিল থেকে পাওয়া কমিশন। ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই সমিতি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা ওয়াসার সাতটি রাজস্ব অঞ্চলে গ্রাহকের কাছ থেকে বিল আদায়ের কাজ করে। এর বিপরীতে তারা মোট বিলের ১০ শতাংশ কমিশন হিসেবে পেয়েছে।