রাজধানীবাসীর বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাওলা থেকে ফার্মগেট অংশ আজ শনিবার (০২ সেপ্টেম্বর) উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকেল সাড়ে ৩টায় শেরেবাংলা নগরের পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এক্সপ্রেসওয়েটির উদ্বোধন করবেন তিনি।
আগামীকাল রোববার (০৩ সেপ্টেম্বর) ভোর থেকে এটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। ৬০ কিলোমিটার গতির একটি গাড়ি মাত্র ১০ মিনিটে কাওলা থেকে ফার্মগেট পৌঁছাতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার যানবাহন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যেতে পারবে। এক্সপ্রেসওয়েটি রাজধানীর যানজট এবং যাতায়াতের খরচ অনেকাংশে কমিয়ে দেবে। এটি সম্পূর্ণভাবে নির্মাণ হলে রাজধানীর কাওলা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে যাওয়া যাবে অল্প সময়ে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এএইচএমএস আক্তার জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় শেরেবাংলা নগরের পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এক্সপ্রেসওয়েটির উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনের পরদিন রোববার বিমানবন্দর-ফার্মগেট অংশটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। এই অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার। বোর্ডিংয়ের জন্য ১৫টি র্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে বনানী ও মহাখালীতে দুটি র্যাম্প আপাতত বন্ধ থাকবে।
এই কর্মকর্তা জানান, এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা হবে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। থ্রি হুইলার, সাইকেল এবং পথচারীদের এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করতে দেওয়া হবে না। মোটরবাইক এখনই চলতে পারবে না। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস (১৬ আসনের কম) এবং মিনি-ট্রাক (৩ টনের কম) ৮০ টাকা, মাঝারি আকারের ট্রাক (৬ চাকা পর্যন্ত) এবং ছয় চাকার বেশি বড় ট্রাক যথাক্রমে ৩২০ টাকা এবং ৪০০ টাকা দিতে হবে।
সুফল মিলবে কী রাজধানীবাসীর
বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিষয়ে সেতু কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা শহরের যানজট অনেকাংশে কমে যাবে এবং ভ্রমণের সময় ও খরচ হ্রাস পাবে। সার্বিকভাবে যোগাযোগব্যবস্থার সহজীকরণ, আধুনিকায়ন হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৪ সালে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে ঢাকার যানজট নিরসনের পাশাপাশি উত্তর ও দক্ষিণের রুটের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টিও উঠে আসে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট বাহনগুলো শহরে ঢুকতে যাতে কোনো ধরনের বাধার মুখে না পড়ে সরাসরি বাইপাস করে চলে যেতে পারে সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ঢাকার বাইরে বিশেষ করে গাজীপুরের দিক থেকে বা উত্তরবঙ্গ থেকে যে গাড়িগুলো অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে আসে, সেগুলো যেন ঢাকাকে বাইপাস করে চট্টগ্রামে চলে যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে যানজট নিরসনের জন্য ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে গাড়ি উঠা ও নামার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে যেটুকু রাস্তা চালু হবে তাতে কেবল ঢাকার মধ্যেই যোগাযোগ তৈরি হবে। এছাড়া গণপরিবহন ও মোটরসাইকেলের যাত্রীরাও এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারবে না। অন্যদিকে শহরের প্রেক্ষাপটে ভোরবেলা ও গভীর রাতে ঢাকার রাস্তাও ফাঁকা থাকে। সেক্ষেত্রে টোল দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের সংক্ষিপ্ত রাস্তা ব্যবহারের আকর্ষণও কম থাকবে। সব মিলিয়ে যানজট নিরসনে খুব বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যানজট বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে।
এর আগে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দুটি র্যাম্প নিয়ে আপত্তি তুলেছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আপত্তি ছিল কাকলীতে ডাউন র্যাম্প নিয়ে। সংস্থাটি বলেছিল, এ সংযোগ সড়কের কারণে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট বেড়ে যাবে।
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আপত্তি জানায় পলাশীর র্যাম্প নিয়ে। তাদের দাবি ছিল, এর কারণে ওই এলাকায় যানবাহনের চাপ বহু গুণ বেড়ে যাবে। পরবর্তী সময়ে আলোচনার মাধ্যমে সব পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই জায়গাগুলোতে র্যাম্প নামানো হয়।
এক্সপ্রেসওয়ের যতটুকু উদ্বোধন করা হবে তা যানজট দূর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন না গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক। বিবিসিকে তিনি বলেন, এইখানে যে র্যাম্প নামছে তার কয়েকটি জায়গা যানজটের হটস্পট হিসেবে পরিচিত। মোড় ও বাস টার্মিনালের কাছাকাছি হওয়ায় যে জায়গাগুলো ইতোমধ্যেই অনবরত যানজট তৈরি করে যাচ্ছিল, সেই জায়গায় বাড়তি গাড়ির চাপ ট্রাফিক আরও বাড়িয়ে দেবে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, আগের নির্মিত প্রকল্পগুলোতেও একই বিষয় দেখা গিয়েছে। যানজট নিরসনে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও তা খুব বেশি কাজে দেয়নি। বরং মৌচাক কিংবা বনানী ফ্লাইওভারের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, ফ্লাইওভারের ওপরে নির্বিঘ্নে গাড়ি চললেও উঠা ও নামার সময় ব্যাপক যানজটের মুখোমুখি হতে হয়।
রাস্তাকে বোতলের সঙ্গে তুলনা করলে উঠা ও নামার এই জায়গাটা হবে বোতলের গলা। আর বোতলের গলা চওড়া না করলে এই জায়গার চলাচল নির্বিঘ্ন করার কোনো সুযোগ নেই। এক্সপ্রেসওয়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে এর সঙ্গে একমত নন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ঢাকা শহরের যানজট কমানোর জন্যই এক্সপ্রেসওয়েটি করা হয়েছে। সম্পূর্ণ চালু হলে পুরোপুরি লাভ পাওয়া যাবে।
যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে নিচের চলাচল করা গাড়ির কিছুটা উপরে চলে গেলে নিচের অংশ কিছুটা হলেও রেহাই পাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ওঠা ও নামার পথকে বলা হয় র্যাম্প। এই র্যাম্পগুলো যানজট বেড়ে যাবার একটি কারণ হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। প্রকল্পের মূল পরিকল্পনায় সংযোজন করে পরবর্তী সময়ে ঢাকাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে নতুন সংযোজিত র্যাম্পগুলোর মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে গাড়ি উঠাবে ও নামাবে। একদিকে নিচের রাস্তাগুলোর সক্ষমতা কম থাকায় র্যাম্পগুলো নিচের রাস্তায় যেমন যানজট তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করেছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সাথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ না থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাদেরই এই ভোগান্তি পোহাতে হবে। এছাড়াও রেল লাইনের ওপরেই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করায় পরবর্তী সময়ে ঢাকার আশেপাশে যে জেলার সঙ্গে রেললাইন সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে একেক সময় একেকটা উপাদান যোগ করা হচ্ছে, কিন্তু এর কী প্রভাব সামগ্রিক শহরে এবং ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারে পড়বে তা চিন্তা করা হয়নি।’
প্রকল্প অনুযায়ী, প্রথম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯ জানুয়ারি ২০১১ এবং পর্যালোচনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩। প্রকল্প সমাপ্তির সময়কাল ছিল জুলাই ২০১১ থেকে জুন ২০২৪। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৯৪০ কোটি টাকা, এতে ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং (ভিজিএফ) তহবিল দুই হাজার ৪১৩ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশ সরকার প্রদান করবে।
ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেড বিনিয়োগকারী কোম্পানি। এতে ইতালীয় থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার রয়েছে ৫১ শতাংশ, চায়না শানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপের (সিএসআই) শেয়ার ৩৪ শতাংশ এবং সিনোহাইড্রো কর।