পতিত হাসিনা সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয় আর্থিক তথা ব্যাংক খাতে। ব্যাংক খাতে ভঙ্গুরতার প্রকৃত চিত্র আড়াল করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার, কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোয় নজিরবিহীন অনিয়ম হয়ে একপর্যায়ে তারল্য–সংকটে পড়ে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাবে ঘাটতি রেখে লেনদেনের সুযোগ দিয়ে সংকট ধামাচাপা রাখার চেষ্টা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা সাতটিসহ ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে দিয়েছে। আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা উদ্ঘাটন ও ব্যাংক খাত সংস্কারে তিনটি টাস্কফোর্স গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আর্থিক খাত অন্তত পতনোন্মুখ অবস্থা থেকে উঠে এসেছে। অস্থির ডলার বাজারে ফিরেছে কিছুটা স্বস্তি। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে গতি এসেছে। শিল্পাঞ্চলে কিছু অসন্তোষ সত্ত্বেও রফতানি এখন ইতিবাচক ধারায়।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
ড. ইউনূস সরকারে দায়িত্ব নেওয়ার পরপর শুরু থেকেই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতির কারণে ধানের মৌসুম এবং শীতের সবজিতে বাজার সয়লাব হলেও খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দুই অংকের উপরে ছিল। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি টানা তিন মাস মূল্যস্ফীতি কমে আসার মধ্যেও খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। ফেব্রুয়ারি মাসে এসে এই হার এক অংকে নেমেছে। মাসটিতে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশে, যা গত ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সবশেষ ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত জানুয়ারিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার চার মাস পর এক অংকের ঘরে নেমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়েছিল, ফেব্রুয়ারিতে এসে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। এর অর্থ হলো, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় মিলেছে, তা ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে কিনতে ব্যয় করতে হয়েছে ১০৯ টাকা ৩২ পয়সা।
বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সার্বিক মূল্যস্ফীতি মাসের ব্যবধানে এতটা কমে যাওয়ার কারণ হলো নিম্নমুখী খাদ্য মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারিতে এসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১ দশমিক ৪৮ শতাংশ পয়েন্ট কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে, যা জানুয়ারিতেও ছিল ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ।
রফতানি আয়ে ইতিবাচক প্রবাহ
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই রফতানি আয়ে ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা গেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) বলছে, গেল বছরের নভেম্বরে টানা চতুর্থ মাসের মতো বাংলাদেশের রফতানি বেড়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতির কারণে কার্যাদেশ বেড়েছে। পাশাপাশি এখন বড়দিনের মৌসুম চলছে, যা রফতানি প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।
ইপিবির তথ্যে দেখা গেছে, নভেম্বরের রফতানি বার্ষিক প্রায় ১৬ শতাংশ বেড়ে চার দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এই রফতানি প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি স্বস্তির খবর, কারণ সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ডলার সংকটসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশে অর্থনীতি। বাংলাদেশের বার্ষিক রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। নভেম্বরে এই খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ শতাংশ।
ইপিবির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওভেন পোশাক রফতানি ২০ শতাংশ এবং নিটওয়্যার রফতানি ১২ দশমিক আট শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া নভেম্বরে হিমায়িত ও সাধারণ মাছ, কৃষিপণ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে। ফলে ২০২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে মোট রফতানি ১৯ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি।
রেমিট্যান্সের জোয়ার
ছাত্র জনতার সাথে জুলাই আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছিল প্রবাসীরাও। বন্ধ করেছিল রেমিট্যান্স প্রবাহ। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রেমিট্যান্স প্রবাহের নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। সর্বশেষ চলতি মাস মার্চে প্রথম ১৫ দিনে ১৬৫ কোটি ৬১ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে) যার পরিমাণ ২০ হাজার ২০৪ কোটি টাকার বেশি। আর প্রতিদিন আসছে ১১ কোটি ডলারের (১৩৪৭ কোটি টাকা) বেশি। রেমিট্যান্স আসার এ ধারা অব্যাহত থাকলে মাসের পুরো সময়ে তিন বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে রেমিট্যান্স। যা দেশের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়তে পারে। এরআগে এর আগে গত ডিসেম্বরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আসে। চলতি মাসে আবারও নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে প্রবাসী আয়।
রিজার্ভ স্থিতিশীলতা
একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রধান নির্দেশক হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এটি মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ, যা আমদানি ব্যয় মেটানো, মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করা এবং বৈদেশিক দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে রিজার্ভ তলানীতে নেমেছিল। তবে বর্তমান সরকারের নানা পদক্ষেপের পর স্থিতিশীল রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের ঘরে ওঠানামা করছে। চলতি মার্চ মাসের ৬ তারিখ পর্যন্ত দেশের গড় রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১৪০ কোটি ডলার।
দুই অংকের ঘরে পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধি
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বিশ্বের প্রধান বাজারগুলোতে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি দুই অংকের ঘরে পৌঁছেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) রফতানি বিশ্বব্যাপী ১০.৬৪ শতাংশ বেড়ে ২৬.৭৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের পোশাক রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে ৫০.১০ শতাংশ শেয়ার নিয়ে শীর্ষে রয়েছে, যেখানে মোট রফতানি ১৩.৪২ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি ৫.০৬ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রফতানির ১৮.৯১ শতাংশ। কানাডায় রফতানি হয়েছে ৮৪৫ মিলিয়ন ডলার, যা ৩.১৬ শতাংশ শেয়ার দখল করেছে। এছাড়া যুক্তরাজ্যও গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে রয়েছে, যেখানে রফতানি ২.৯৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা মোট রফতানির ১০.৯৪ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির দিক থেকে ইইউতে পোশাক রফতানি আগের বছরের তুলনায় ১১.৫৩ শতাংশ বেড়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ১৬.৩৮ শতাংশ এবং কানাডায় ১৪.১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্যে প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলক কম ৩.৭৪ শতাংশ।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে জার্মানি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার; যেখানে ৩.৩৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এছাড়া স্পেনে ২.৩৫ বিলিয়ন, ফ্রান্সে ১.৪৩ বিলিয়ন, ইতালিতে ১.০৫ বিলিয়ন, পোল্যান্ডে ১.১৩ বিলিয়ন এবং নেদারল্যান্ডসে ১.৪৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে।
পাচারের পথ বন্ধ
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল (ক্রীড়নক), আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। সম্প্রতি অর্থনীতি নিয়ে তৈরি একটি শ্বেতপত্র প্রতিবেদন সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। ওই প্রতিবেদনে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের টাকা পাচারের আনুমানিক এই চিত্র তুলে ধরা হয়। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি রিপোর্টস (জিএফআইআরএস) এবং কিছু নির্দিষ্ট পূর্বানুমানের ভিত্তিতে টাকা পাচারের হিসাব করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। বর্তমান সরকার অর্থ পাচার ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পাশাপাশি ইতোমধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থ পাচার ঠেকাতে নতুন করে একটি বিভাগ খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ, চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম. হেলাল আহম্মেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলেন, বর্তমানে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিগত সময়ের চেয়ে অনেকটা প্রশংসনীয়। বিশেষত খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। বিগত সরকারের সময়ে দেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, খেলাপি ঋণ বেড়েছে, পুঁজিবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উধাও হওয়ার পরেও দেশ যে স্বাভাবিক অবস্থায় চলছে এর কৃতিত্ব অবশ্যই বর্তমান সরকারকে দিতে হবে। তবে এ অবস্থা টেকসই করতে হলে তাদের আরো কিছুদিন সময় দিতে হবে। একটা ভঙ্গুর অর্থনীতিকে এতো দ্রুত সময়ে সঠিক পথে আনা সম্ভব নয়। আমাদেরকে বর্তমান সরকারের উপর আস্থা রাখতে হবে।