মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালে আদালতের আদেশ অমান্যকারীদের বিষয়ে সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না বিজ্ঞ বিচারকরা। তাই আদালতের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে দন্ডবিধি, ১৮৬০-এর ২২৮ ধারা মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলে অন্তর্ভুক্তের প্রস্তাব করেছেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। পাশাপাশি দেশের সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর সিন্ডিকেট/পরিচালনা কমিটিতেও তাদের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে জেলা পর্যায়ে ডিসিদের সাধারণ কার্যাবলির মধ্যেই রয়েছে ৬২টি বিষয়। একেকটি বিষয়ের জন্য জেলা পর্যায়ে একাধিক কমিটি রয়েছে। এসব কমিটির কার্যক্রম তদারকির পাশাপাশি আরও ক্ষমতা চান ডিসিরা।
জানা গেছে, ডিসিদের বর্তমানে ২২টি পণ্যের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে জেলার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক নিয়োগেও নিজেদের সম্পৃক্ততা চান ডিসিরা। উপজেলা পরিষদের কর্মচারী বদলির ক্ষমতা, প্রকল্প ছাড়া সব ধরনের তৃতীয় শ্রেণির নিয়োগ ডিভিশনাল সিলেকশন বোর্ডের অধীন আনা, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার সুযোগ সৃষ্টি, ডিসির স্বেচ্ছাধীন তহবিলের বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং জেলা পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা কমিটির নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ও অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে পুলিশি প্রতিবেদনের পাশাপাশি ইউএনওদের মতামত গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
এসব বিষয়সহ বিভিন্ন জেলার ডিসিদের পাঠানো মোট ২৬৩টি প্রস্তাব উঠছে ১৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলনে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে আরও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের জন্য ডিসিকে প্রধান করে জেলা কমিটি গঠন, ক্ষুদ্র ঋণদাতা এনজিওগুলোর ডিসির প্রত্যয়নপত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করা, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কার্যক্রমে ডিসিদের সম্পৃক্তকরণ, প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাবকালে ডিসির মতামত গ্রহণ এবং ডিসির নেতৃত্বে জেলার যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও তদারকির জন্য জেলা কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য ডিসির নেতৃত্বে জেলা কমিটি গঠন, ডিসির নেতৃত্বে সব জেলায় শ্রমিক-মালিক সংকট নিরসনে সমন্বয় কমিটি গঠন, বাণিজ্য মেলা আয়োজনে ডিসির অনুমতি নেওয়ার বিধান যোগ এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও সার্কিট হাউসের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রদানের সুপারিশ করেছেন ডিসিরা।
এ ছাড়া জরুরি হুকুম দখল আইনের আওতায় অনিষ্পন্ন গেজেট প্রকাশনার বিষয়টি স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন-২০১৭ এর মতো ডিসিদের ক্ষমতা দেওয়া এবং ডিসি সম্মেলনের মতো প্রতিবছর একবার বিভাগীয় পর্যায়ে ইউএনও সম্মেলন করার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় গত বৃহস্পতিবার থেকে দেশে বিধিনিষেধ জারি করেছে সরকার। এর মধ্যেই কাল থেকে শুরু হচ্ছে তিন দিনের ডিসি সম্মেলন। ইতোমধ্যে কর্ম অধিবেশন সূচি প্রকাশ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এবারের সম্মেলনে ২১টি কার্য অধিবেশনসহ মোট ২৫টি অধিবেশন থাকবে।
এরমধ্যে প্রথম দিন ৭, দ্বিতীয় দিন ৮ এবং তৃতীয় দিন ১০টি অধিবেশন থাকবে। কর্ম অধিবেশনগুলোতে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলো আলোচনা হবে। এবারের সম্মেলন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম দিন বেলা ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। ওইদিন সন্ধ্যা ৬টায় ভার্চুয়ালি দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেবেন রাষ্ট্রপতি। দ্বিতীয় দিন বিকাল সোয়া ৪টায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে স্পিকার শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন। সন্ধ্যা ৬টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন প্রধান বিচারপতি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত ১৪টি প্রস্তাব দিয়েছেন ডিসিরা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জনপ্রশাসন পদায়ন নীতিমালা সংশোধনের প্রস্তাব করেছেন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার। ডিসির স্বেচ্ছাধীন তহবিলে প্রতি অর্থবছর বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন রাজবাড়ী, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝালকাঠি ও পটুয়াখালীর ডিসি। জাতিসংঘ মিশনে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির প্রস্তাব করেছেন রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের স্মার্ট আইডি কার্ড দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডিসি। বিভাগীয় শহরে সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব করেছেন নওগাঁর ডিসি। স্থানীয় প্রকল্পে ডিসির মতামত নিতে ডিসি অফিসে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন ভোলার ডিসি।
জননিরাপত্তা বিভাগ : এই বিভাগের মোট সাতটি প্রস্তাব দিয়েছেন ডিসিরা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-জুয়াখেলা বন্ধে ১৮৬৭ সালের বঙ্গীয় প্রকাশ্য জুয়া আইন সংশোধন করে শাস্তি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন মৌলভীবাজারের ডিসি। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছেন কুমিল্লার ডিসি। এ ছাড়া সুরক্ষা সেবা বিভাগের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে- বন্দিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতে অ্যাম্বুলেন্স বৃদ্ধি ও ফায়ার স্টেশনে ডুবুরির পদ সৃষ্টি এবং কারাবিধি সংশোধন করে কারাগারে ধূমপান নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছেন লক্ষ্মীপুরের ডিসি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা : এই বিভাগের মোট ১২টি প্রস্তাব দিয়েছেন ডিসিরা। এরমধ্যে অন্যতম হলো- পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনার জন্য উপজেলা সদরে আলাদাভাবে পরীক্ষা কেন্দ্র ভবন নির্মাণ করার প্রস্তাব দিয়েছেন ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, খুলনা, নড়াইল ও নোয়াখালীর ডিসি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সব ধরনের লেনদেন ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আনার প্রস্তাব দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডিসি। এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব ক্লাসের পাঠ্যসূচিতে ভূমি সংক্রান্ত বিষয়াবলি অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দিয়েছেন রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার। ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছেন ময়মনসিংহের ডিসি। উপজেলা পর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন চট্টগ্রামের ডিসি।
গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু প্রস্তাব : এ ছাড়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দিয়েছেন ডিসিরা। এরমধ্যে রয়েছে- করাতকলের লাইসেন্স দেওয়ার শর্ত হিসেবে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডিসি। ইটভাটায় কৃষি জমির ওপরের স্তর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি জমি সুরক্ষার প্রস্তাব দিয়েছেন চাঁদপুরের ডিসি। জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে স্থানীয়ভাবে বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসির মাধ্যমে প্রতিনিধি মনোনয়ন দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন নেত্রকোনার ডিসি। তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে বিকল্প লাভজনক অর্থকরী ফসল উৎপাদনে প্রণোদনার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছেন বান্দরবানের ডিসি। মাদারীপুরের ডিসি প্রস্তাব করেছেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নিজ জেলার বাইরে অন্য জেলায় পদায়ন করতে। সব উপজেলার পৌর এলাকায় ওএমএস কর্মসূচি চালুর প্রস্তাব দিয়েছেন সিলেটের ডিসি। জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ/সিসিইউ স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছেন বাগেরহাট ও মাগুরার ডিসি। সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় মামলা পরিচালনার জন্য স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস চালুর প্রস্তাব দিয়েছেন ফরিদপুরের ডিসি। ১৩০ বছরের পুরনো রেলওয়ে আইন সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছেন দিনাজপুরের ডিসি।