রাজধানীর কলাবাগানে গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপি (৪৬) হত্যাকাণ্ডের সাত দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার পর থেকে সন্দেহভাজন, প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহতের স্বজনদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো ক্লু মিলছে না।
তবে ঘটনার আলামত বিশ্লেষণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, ‘খুনি ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে পালিয়েছে।’ এ ঘটনায় থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব, পিবিআইসহ সবাই ‘ক্লু’ উদ্ধারে কাজ করছে। সবার ভাষ্য, হত্যাকাণ্ডটি ক্লু লেস ও জটিল।
তবে কলাবাগানের ১ম লেনের ৫০/১ নম্বর বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, চল্লিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি ডা. লিপির বাসায় যাতায়াত করতেন। চেহারায় শ্যাম বর্ণের ও শরীরের গঠন হালকা পাতলা ওই ব্যক্তিকে এখনো চিহ্নিত করতে পারেনি। মূলত ঘাতক নিহতের পূর্বপরিচিত-এটা নিশ্চিত পুলিশ। ফ্ল্যাটে প্রবেশ দরজার সামনে যে দুটি সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে তা ঘাতকের কি না-তা নিশ্চিত হতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তারা বলছেন, ডা. সাবিরার কোনো পরকীয়া প্রেমিক আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সন্দেহ রয়েছে সহভাড়াটিয়া কানিজ সুবর্ণা ও নুরজাহানের প্রতিও। তবে নুরজাহান ঈদের দিন থেকে গোপালগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করায় তার দিকে সন্দেহটা কম।
এরপরও নুরজাহানকে ডেকে নিয়ে নানান বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গত রোববার (৬ জুন) ও সোমবার (৭ জুন) পিবিআই নুরজাহানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
পিবিআই দক্ষিণের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) তৃপ্তি মন্ডল জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘নুরজাহান পিবিআইয়ের কাছে হত্যার বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন। গত ঈদের দিন থেকে তিনি গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে ছিলেন বলে দাবি করেছেন। এরপরও আমরা নানা বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেছি। কিছু তথ্য পেয়েছি সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে।’
পিবিআই সূত্র জানায়, নুরজাহানের চলাফেরা ছিল সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। তার মায়ের কাছে সে বেশিরভাগ সময় থাকতো। আবার একাই ফ্ল্যাট নিয়েছে। সেখানে দুই রুম সাবলেট ভাড়া দিয়েছে দুই মেয়েকে। ঈদের পর প্রথম ওই বাসায় থাকেন ডা. সাবিরা। ওইদিন রাতে তার স্বামী আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার দুই শিফটে ডিউটি আছে বলে স্বামীকে আসতে দেননি। অথচ ওইদিন তিনি ডিউটিতে যাননি। তিনি বাসাতেই ছিলেন এবং সকালে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
ধারণা করা হচ্ছে ফজরের নামাজের আগে চিকিৎসক সাবিরাকে খুন করা হয়। তাকে প্রথমে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলায় ধারালো চাকু দিয়ে আঘাত করা হয়। হত্যাকাণ্ড ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে ওই কক্ষে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে চিকিৎসক সাবিরাকে। খুনি ফ্ল্যাটের সব তথ্যই জানত। ফলে পালাতে সুবিধা হয় খুনির। বাড়ির দারোয়ান সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করত না। আবার ওই বাসাতে কোনো সিসি ক্যামেরাও নেই। আশেপাশের কোনো বাড়িতেও নেই। এমনকি কয়েকটি সড়কেও সিসি ক্যামেরা নেই। দূরের একটি সড়কে ক্যামেরা রয়েছে। সেটির ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগের উপ কমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক বলেন, ‘এখনও হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদঘাটন করা যায়নি। আমরা সম্ভাব্য সব বিষয় আমলে নিয়ে তদন্ত অব্যাহত রেখেছি। যেহেতু হত্যাকাণ্ডটি ক্লু লেস সেহেতু উদঘাটনে একটু সময় লাগবে।’
ডিবি সূত্র জানায়, ঘটনার পর সাবলেটে থাকা কানিজ সুবর্ণা এবং তার এক ছেলে বন্ধুকে ডিবি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ঘটনার রাতে পাশের কক্ষে কানিজের সঙ্গে রাত্রি যাপন করেছে ওই ছেলে বন্ধুটি। পাশাপাশি কক্ষে থাকলেও হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেননি তারা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘সব দিক মাথায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে চিকিৎসকের ফোন কল যাচাইবাছাই করা হচ্ছে।’
ডা. সাবিরার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাবিবার প্রথম বিয়ে হয় ২০০৩ সালে। সেই স্বামী চিকিৎসক ছিলেন। তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এই পক্ষে এক ছেলে রয়েছে সাবিরার। পরে ২০০৫ সালে ব্যাংকার সামসুদ্দিন আজাদকে বিয়ে করেন সাবিরা। সামসুদ্দিন আজাদের দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিরা। আজাদের প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর সাবিরাকে বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর পক্ষের এক মেয়ে রয়েছে আজাদের। সাবিরার সঙ্গে বিয়ের পর আরেক মেয়ে হয়। রাজধানীর শান্তিনগরে নিজের ফ্ল্যাটেই থাকতেন তারা।
তবে ২০১৭ সাল থেকে মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকা শুরু করেন সাবিরা। প্রথমে মায়ের বাসায় থাকলেও পরে আলাদা ফ্ল্যাট নেন তিনি। সাবিরার ফ্ল্যাটে খুব একটা আসতেন না আজাদ। এ নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্যও হতো। সাবিরা খুব জেদি প্রকৃতির ছিলেন। নাম প্রকাশ না করে সাবিরার ঘনিষ্ঠ একজন বলেন, ‘সাবিরা তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্বামীর সম্পত্তি দাবি করেছিলেন। দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন নিয়েও মনোমালিন্য চলছিল। এ কারণেও ঘটতে পারে হত্যাকাণ্ড।’
সাবিরার স্বামী সামসুদ্দিন আজাদ বলেন, ‘মরদেহ উদ্ধারের আগের রাতেও সাবিরার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। আমি ৯টা ৫৭ মিনিটে সাবিরাকে মেসেঞ্জারে কল করি। কিন্তু তখন রিসিভ করেনি। পরে রাত ১০টা ২৮ মিনিটে আমাকে কল ব্যাক করে সাবিরা। প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিট কথা হয়। তখন স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেছিল সে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ থাকায় ওই বাসায় ঠিকমতো যেতে পারতাম না। এ নিয়ে তার ক্ষোভ ছিল। ঘটনার আগের রাতেও আমাকে বলেছে, বাসায় আসার সময় হয় না তোমার। আমি তখন বলি কাল আসি তাহলে। তখন আমাকে বলে না কাল তার দুই শিফটে অফিস। দুই দিন পরে যেতে। ’ সম্পত্তি নিয়ে কোনো বিরোধ ছিল কিনা জানতে চাইলে আজাদ বলেন, ‘কারও সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। সাবিরারও কোনো শত্রু নেই।’
এ বিষয়ে কলাবাগান থানার ওসি পরিতোষ চন্দ্র জানান, আমরা মামলার ক্লু উদঘাটনের চেষ্টা করছি। এখন পর্যন্ত খুনের মোটিভ জানা যায়নি। যাদের সন্দেহ হচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ভিকটিমের মামাতো ভাই ও মামলার বাদী রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েল জানান, মামলার তদন্তকারীদের প্রতি আমাদের আস্থা আছে। তারা খুনিকে চিহ্নিত করে আইন আওতায় আনবে বলে আশা করি।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ মে সকালে রাজধানীর কলাবাগানের ৫০/১ নম্বর ছয়তলা বাড়ির তৃতীয়তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমানের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ওই ফ্ল্যাট থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হতে দেখে স্থানীয়রা ফায়ার সার্ভিসে খবর দেন। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আসার আগেই স্থানীয়রা সহভাড়াটে কানিজ সুবর্ণার সহায়তায় ফ্ল্যাটটিতে প্রবেশ করে। পরে সাবিরার কক্ষের তালা ভেঙে আগুন নেভায় তারা। ওই ফ্ল্যাটের যে কক্ষ থেকে সাবিরার লাশ উদ্ধার করা হয়, তার পাশে আরও দু’টি কক্ষে দুই সহভাড়াটে থাকেন। তাদের একজন আরবি শিক্ষক নুরজাহান (২৭), অন্যজন মডেল কানিজ সুবর্ণা (২৫)।