ডলার সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে ছোট ও মাঝারি শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। আগে খোলা এলসির পণ্য দেশে আসতে শুরু করায় এ খাতে আমদানি কিছুটা বেড়েছে।
তবে নতুন করে এলসি খোলা কমে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে এ খাতের কাঁচামাল আমদানিও কমে যেতে পারে। ডলার আয়কারী রপ্তানিমুখী বড় শিল্পের জন্য এখনো ডলারের সংস্থান রয়েছে। যে কারণে ভালো রপ্তানিকারকদের কাঁচামাল আমদানিতে এখনো তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে আমদানি ব্যয় বেড়েছে অনেক। যে কারণে আগের চেয়ে বেশি দামে কম পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে।
এদিকে নতুন রপ্তানির অর্ডার কম আসায় কাঁচামাল আমদানির ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলা কমে গেছে। প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান করতে না পারায় কাঁচামাল আমদানি নির্ভর শিল্পগুলো এলসি খুলতে পারছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতাও কমে গেছে।
সূত্র জানায়, বিশেষ করে ডলার সংকট মোকাবিলায় অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার থেকে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এতে আমদানিতে লাগাম পড়েছে। বর্তমানে ডলার সংকট এতটাই প্রকট হয়েছে যে, উদ্যোক্তাদের মধ্যে যারা ডলার আয় করে না, তারা এখন কোনো এলসি খুলতে পারছেন না। টাকায় শতভাগ মার্জিন দিয়েও এলসি খোলা যাচ্ছে না শুধু ডলারের অভাবে।
এতে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর শিল্পগুলো সংকটে পড়েছে। ভুক্তভোগীরা এলসি খুলতে না পেরে চড়া সুদে বায়ার্স ক্রেডিট বা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে ঋণ নিয়ে এলসি খোলার চেষ্টা করছেন। এ চেষ্টায় অনেকে সফল হচ্ছেন না। ফলে বাধ্য হয়ে খোলা বাজার থেকে বাণিজ্যিকভাবে আমদানি করা কাঁচামাল চড়া দামে সংগ্রহ করে কারখানা চালু রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান যুগান্তরকে বলেন, ডলার সংকটে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে যারা ডলার আয় করে না, তারা এখন এলসি খুলতে পারছেন না। এর মধ্যে দেশীয় চাহিদা পূরণে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদন করে তারাও এলসি খুলতে পারছেন না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমদানির জন্য শতভাগ টাকা দেওয়া হলেও ব্যাংক ডলার দিতে পারছে না। এছাড়া গ্যাস সংকট তো আছেই। গ্যাসে যেসব কারখানার বয়লার চালাতে হয় তারা পড়েছে বড় সংকটে। গ্যাসের অভাবে উৎপাদন কাজ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় উদ্যোক্তারা চড়া দাম দিয়েও গ্যাস-বিদ্যুৎ নিতে আগ্রহী।
সূত্র জানায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবস্থা আরও করুণ। বিশেষ করে ছোট আকারের শিল্পগুলো সরাসরি কাঁচামাল আমদানি করে না। বাণিজ্যিকভাবে যেসব উদ্যোক্তা কাঁচামাল আমদানি করেন তাদের কাছ থেকে কিনে তারা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে থাকেন।
কিন্তু এখন বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা ডলারের অভাবে এলসি খুলতে পারছেন না। ফলে বাজারে আগে আমদানি করা কাঁচামাল বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে বাণিজ্যিকভাবে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫ শতাংশ। আমদানি বেড়েছে ২৩ শতাংশ। চড়া দামের কারণে আমদানি ব্যয় বেশি হয়েছে। কিন্তু কাঁচামাল এসেছে কম।
সাভারের আমিন এক্সেসরিজের স্বত্বাধিকারী মোতাহার হোসেন বলেন, তিনি পুরান ঢাকা থেকে কাঁচামাল হিসাবে প্লাস্টিকের গুটি কিনতেন প্রতি কেজি ৪৩০ টাকা দরে। এখন কিনতে হচ্ছে এক হাজার টাকায়। ফলে এত চড়া দামে কাঁচামাল কিনে পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। এতে তাদের কারখানাটি বন্ধ হওয়ার পথে। তিনি জানান, বিশেষ করে ছোট উদ্যোক্তাদের এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। কেউই কাঁচামাল পাচ্ছেন না। যা পাচ্ছেন তার দাম অনেক বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-অক্টোবরে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা কমেছে ২৫ শতাংশ। আমদানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ। অক্টোবরে ৯৩ কোটি ডলারের ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার আভাস দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সাময়িক হিসাবে বাস্তবে খোলা হয়েছে আরও কম। নভেম্বরে ৯৩ কোটি ৩৬ লাখ ডলার ও ডিসেম্বরে ৮৭ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের এলসি খোলা হতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আভাস দিয়েছে। অর্থাৎ কাঁচামাল আমদানি আরও কমবে। কাঁচামালের আমদানি কমলে রপ্তানিও কমে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানির দায় ২৭৪ কোটি ডলার হতে পারে। এর মধ্যে ৫৪ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা এখন বিভিন্নভাবে সংরক্ষণ করা আছে। বাকি ডলার রপ্তানিকারকের আয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রপ্তানিতে এখন বড় সংকট বৈশ্বিক মন্দা। এতে পোশাক রপ্তানির আদেশ কমে গেছে। এর প্রভাবে কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। ফলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব আসতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে শিল্পের মৌলিক কাঁচামালের এলসি কমেছে ১২ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ২৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের ওই সময়ে মৌলিক কাঁচামালের এলসি ৪০ শতাংশ এবং আমদানি ৪৮ শতাংশ বেড়েছিল।
মৌলিক কাঁচামালের মধ্যে বীজের এলসি ৪২ শতাংশ, টেক্সটাইল ফেব্রিক্সের এলসি ২২ শতাংশ, কটন ইয়ার্নের এলসি ৪৫ শতাংশ, কোপরার এলসি ৪২ শতাংশ, সিনথেটিক সুতার এলসি ৩৬ শতাংশ, বস্ত্র খাতের মৌলিক কাঁচামাল তুলার এলসি ৩২ শতাংশ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে থেকে দেখা যায়, বেশ কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি করে। বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের মন্ড আমদানি করে তারা দেশে পণ্য তৈরি করে। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে এসব শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির এলসিও কমেছে ২২ শতাংশ।
এরমধ্যে সিমেন্টের এলসি ৩৩ শতাংশ, বিপি শিটের ৪৪ শতাংশ, টিন প্লেটের এলসি ৬৫ শতাংশ এবং স্ক্র্যাব ভেসেলের এলসি ৫৫ শতাংশ কমেছে। এসব কাঁচামালের বড় অংশই নির্মাণ খাতে ব্যবহৃত হয়। ফলে সিমেন্ট, রড, স্টিল শিট, টিন উৎপাদন কমে গেলে নির্মাণ খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।