ব্যাংকগুলোর ঋণ অনিয়মের কারণে এই খাতের ওপর মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হওয়ায় নগদ টাকার ওপর প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতেও। কারণ, ব্যাংকগুলোর ডলার কিনে আমদানি ব্যয় মিটাতে হয়। বর্তমানে ডলারপ্রতি দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা বাড়ায় ডলার ক্রয়ে টাকার সংকটে পড়তে হচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ডলারের দাম ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান বেড়েছে। এছাড়া ব্যাংকিং খাতের অতিরিক্ত তারল্য কমেছে মূলত আমদানি অর্থায়নের কারণে। ঋণদাতারা এখন ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তির জন্য ডলার কিনতে স্থানীয় মুদ্রা ব্যয় করছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাপনের খরচ বেড়েছে গেছে। এ জন্য অনেকে জমানো টাকা তুলে ব্যয় মেটাচ্ছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ অনিয়মের ফলে ব্যাংকিং খাত থেকে মানুষ ব্যাপক টাকা তুলে নিয়েছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যও কমেছে। মূলত বেশ কয়েকটি দিক থেকে সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। কেউ গুজবে নগদ অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নিচ্ছে, কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, টাকার মান কমে যাওয়াসহ কয়েকটি বিষয়গুলো এর ওপর চরম প্রভাব ফেলছে বলেও মনে করছেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর ঋণের বিপরীতে আমানত জমা নিম্নমুখী বা অর্ধেকে নেমে এসেছে। আবার আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম হওয়ায় গ্রাহকরা ব্যাংকে নগদ রাখা রাখছে না। সম্প্রতি ইসলামী ধারার কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়ম হলে গ্রাহকদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় গত নভেম্বর মাসেই আমানত কমে যায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার মতো। পরের মাস ডিসেম্বরেও আমানত কমেছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, মানুষ ব্যাংকে যে টাকা আমানত হিসেবে জমা রাখে, ব্যাংক তাই ঋণ হিসেবে বিতরণ করে থাকে। ব্যাংক খাতে গত সেপ্টেম্বরে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এছাড়া গত নভেম্বরে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে হয় ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশে। ফলে আমানতের তুলনায় ব্যাংকগুলোতে ঋণ বেশি যাচ্ছে।
আবার অনেকে খরচ মেটাতে সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। এতে মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন করে সঞ্চয়ও কমে এসেছে। পাশাপাশি আতঙ্কে অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে রাখছেন। এসবের মাঝে সাম্প্রতিক সময়ে দাম বাড়ায় ডলার কেনা, রেমিট্যান্স কেনা ও রফতানি বিল নগদায়নে গ্রাহকদের বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। আবার ব্যবসায় মন্দার কথা বলে ব্যবসায়ীরাও ঋণ পরিশোধ কমিয়ে এনেছেন। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোতে তারল্যের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ঢাকা মেইলকে বলেন, মোট আমানত কমে যাওয়া অস্বাভাবিক বিষয়। এটা ব্যাংকিং খাতের জন্য অশুভ সংকেত। কিছু কিছু ব্যাংকের অনিয়মের কারণে এ খাতে মানুষের একটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। মানুষ টাকা জমা করার চেয়ে উত্তোলন বেশি করছে। তাই ব্যাংক আমানত কমেছে।
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদাসীনতার কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের সঠিক প্রয়োগ করেনি। ব্যাংকিং খাতে যেসব অনিয়ম হচ্ছে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্ট কিছু বলছে না। এসব কারণে এখানে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এখনই এর সমাধান না করলে ভবিষ্যতে সংকট আরও গভীর হবে।’
বিদায়ী বছরে (২০২২) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে সবমিলিয়ে ১ হাজার ২৬১ কোটি ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতি ডলার ৯৮ টাকা ধরলে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। গত বছরে ব্যাংকগুলো থেকে এই টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভোল্টে। এতেও অর্থসংকট বেড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ব্যাংকগুলোর হাতে সিআরআর ও এসএলআর রাখার পর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের নভেম্বরে কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ ১১ মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৫৮ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
এ নিয়ে কথা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক ঢাকা মেইলে বলেন, ব্যাংকিং খাতে তারল্য কমার অন্যতম কারণ ডলার সংকট। ব্যাংকগুলোয় ডলার সংকট থাকার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর স্থানীয় মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে এসেছে। এতে ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্য কমে গেছে।