ডলারের দাম বৃদ্ধির ধাক্কা লেগেছে তৃতীয় সাবমেরিন কেবল স্থাপন প্রকল্পে। ফলে শুধু মুদ্রা বিনিময় হারে তারতম্যের কারণেই খরচ বাড়ছে ১৫৬ কোটি ৫২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এছাড়া অন্যান্য কারণে আরও প্রায় ২০৬ কোটি টাকা বাড়ছে। সবমিলিয়ে প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে ৩৬২ কোটি সাত লাখ টাকা। এজন্য ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তৃতীয় সাবমেরিন কেবল স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রথম সংশোধন করা হচ্ছে।
তবে বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে এ ধরনের প্রকল্প অনুমোদন বা সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। আগামীকাল মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হচ্ছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে। খবর পরিকল্পনা কমিশন সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের প্রকল্প তো সংশোধন করার কথা নয়। কেননা দেশীয় টাকায় বিদেশ থেকে ডলারে মালামাল কিনতে হবে। কিন্তু সার্বিকভাবে ডলার সংকট চলছে। সেখানে সরকারিভাবেই এমন প্রকল্প নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এ রকম প্রকল্পের বাস্তবায়ন যাতে ধীরে হয় সেটিই মঙ্গল। তবে বিদেশি অর্থায়ন থাকলে তাহলে ব্যয়ও বাড়ত, লাভও হতো। এ প্রকল্পে দেখা যাচ্ছে বৈদেশিক কোনো ঋণ নেই।
এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আজম আলীর সঙ্গে। রোববার তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে। এখানে ১৬-১৭টি দেশের পার্টি যুক্ত আছে। আমরা যদি দেরি করি তাহলে তারাই আমাদের কনসোর্টিয়াম থেকে বের করে দেবে। এতে ইতোমধ্যেই পেমেন্ট করা ৫০ শতাংশ ডলার কোনো কাজে আসবে না। তাই এ প্রকল্পটিতে ২-৩ মাস দেরি করার সুযোগ নেই। এজন্য সংশোধনী করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৬৯৩ কোটি ১৬ লাখ ৭১ হাজার টাকা। এখন নতুন করে ৩৬২ কোটি ৭ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার ৫৫ কোটি ২৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে ৫২ দশমিক ২৩ শতাংশ। প্রকল্পটি সংশোধনের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয়ের মধ্যে বিভিন্ন মালামাল বিদেশ থেকে কিনতে ডলারের সংস্থান ধরা ছিল। প্রকল্পটি যখন অনুমোদন পায় তখন প্রতি ডলার ধরা হয় ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা করে। কিন্তু পরবর্তীকালে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। ফলে আমদানির জন্য যে টাকা ধরা ছিল তা সংকুলান হচ্ছিল না। এরপর গত সেপ্টেম্বর মাসের হিসাব অনুযায়ী প্রতি ডলার ১০৬ টাকা ৭৫ পয়সা করে ধরে সংশোধনী প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত ১৫৬ কোটি ৫২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। আরও জানা যায়, এ প্রকল্পের পণ্য সরবরাহকারী কনসোর্টিয়ামের সর্বশেষ বাজেট অনুযায়ী ১৩ হাজার ২০০ জিবিপিএস-এর জন্য ৯২ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন হবে। কিন্তু মূল ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) বরাদ্দ আছে ১৭ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাশাপাশি সাবমেরিন ক্যাপাসিটি ইনিশিয়াল লাইট আপের জন্য অতিরিক্ত এক মিলিয়নসহ মোট ৩ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হচ্ছে। এসব বিবেচনায় প্রকল্পটির মোট ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ রোববার যুগান্তরকে বলেন, এ প্রকল্পটি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে কারণ হলো এ ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের বিকল্প নেই। ব্যান্ড উইথ বা ইন্টারনেট ছাড়া এখনো চলাই যায় না। এছাড়া করোনা মহামারির সময় দেখা গেছে ইন্টারনেটের কতটা ভূমিকা ছিল। ফলে ডলারের সংকট এবং রেট বৃদ্ধি পেলেও প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
ঢাকা ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সূত্র জানায়, ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তৃতীয় সাবমেরিন কেবল স্থাপন’ প্রকল্পটি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে বাংরাদেশ সাবমেরিন কেবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (বিএসসিসিএল)। ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরিতে সাবমেরিন কেবল নেটওয়ার্ক দেশের অন্যতম প্রধান অবকাঠামো বলে মনে করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল লংডিস্টেন্স টেলিকমিউনিকেশন্স সার্ভিস পলিসি ও আইসিটি নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে এ কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি বিটিআরসি থেকে লাইসেন্স নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্টোরিয়াল কেবল (আইটিসি) সার্ভিসেস অপারেটরে একই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু এরপরও দেশের ইন্টারনেট চাহিদা প্রায় ৬০ ভাগ পূরণ করছে বিএসসিসিএল। গত জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পের অনুকূলে ব্যয় হয়েছে ১৫৯ কোটি ৯৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক অগ্রগতি ২৩ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ২৭ শতাংশ। এই অবস্থায় অতিরিক্ত ব্যান্ডউইথ কেনার জন্য ব্যয়ের সংস্থান এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারে পরিবর্তনের কারণে সংশোধন করতে হচ্ছে।
একনেকের জন্য তৈরি সারসংক্ষেপে পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিয়েছেন ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) সত্যজিৎ কর্মকার। সেখানে তিনি বলেন, প্রথম এবং দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের পর দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এবং ভবিষ্যৎ প্রয়োজন অনুসারে তৃতীয় সাবমেরিন কেবল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যান্ড উইথ ক্যাপাসিটি ৬ দশমিক ৬ টিবিপিএস-এর পরিবর্তে ১৩ দশমিক ২ টিবিপিএস-এ উন্নীত করা হচ্ছে। এই প্রকল্পটির সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদনযোগ্য।