রাজধানীর অদূরে সাভারে গোলাম কিবরিয়া নামে এক শিক্ষককে হত্যার রহস্য উন্মোচন করেছে র্যাব। সেই সঙ্গে এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে বাহিনীটি। তাদের গ্রেফতারের পর বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর কথ্য। মূলত হত্যাকারীরা সেই শিক্ষকের বাসায় থাকা টাকা লুট করে বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চিরকুটে ‘সমকামী’ লিখে ফেলে রাখে। আর সেই চিরকুটের সূত্র ধরেই হত্যাকারীদের খুঁজে পায় র্যাব।
এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ইমন খান (২৩)। বাকি দুজন হলেন মো. সাগর (২২) ও মো. ছাদেক গাজী (২২)।
সোমবার (২১ আগস্ট) রাতে যশোর, ঝিনাইদহ ও রংপুর এলাকায় যৌথ অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে সহায়তা করে র্যাব-৪, ৬ ও ১৩ এর দল। এসময় উদ্ধার করা হয় লুট করা পাঁচ লাখ ২১ হাজার ৯৯ টাকা।
গত ২০ আগস্ট বিকেলে সাভার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটপাড়া এলাকায় নিজ বাড়ির কক্ষ থেকে স্কুলশিক্ষক গোলাম কিবরিয়ার হাত-পা বাঁধা এবং গলায় গামছা পেচানো অবস্থায় মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় তার লাশের পাশে ‘এই ব্যক্তি সমকামী করে পুলিশ ভাই, আমরা তাই মেরে ফেলেছি, ভাই ও অবৈধ কাজ করে… আমরা ইসলামের সৈনিক’ লেখা একটি চিরকুট পাওয়া যায়। এ ঘটনায় নিহতের ভাই বাদী হয়ে সাভার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) দুপুরে কারওয়ানবাজারের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বিস্তারিত তুলে ধরেন।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, নিহত শিক্ষক গোলাম কিবরিয়া জমি কেনা-বেচা করায় তার কাছে সবসময় বেশি টাকা থাকত। টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষককে হত্যার পর সমকামীর চিরকুট লিখে নাটক সাজায় হত্যাকারীরা।
র্যাবের মুখপাত্র মঈন জানান, এ হত্যাকাণ্ডে মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ইমন। আর গ্রেফতারকৃত সাগর একজন অটো রিকশাচালক হওয়ায় তার সাথে নিহতের দুই বছর আগে পরিচয় হয়। এই সাগরই মূলত নিহত শিক্ষকের সাথে ইমনের পরিচয় করিয়ে দেন। পরিচয়ের সুবাধে গ্রেফতার ইমন ও সাগর শিক্ষক কিবরিয়ার বাসায় মাঝে-মধ্যে যাওয়া-আসা করতেন। এই সুবাধে তার আলমারিতে রাখা জমি ক্রয়-বিক্রয়ের বিপুল পরিমাণ টাকা তাদের নজরে আসে। ইমন ও সাগর শিক্ষককে হত্যা করে তার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এ কাজে ইমন তার বন্ধু ছাদেককে যুক্ত করেন।
র্যাব জানায়, পরিকল্পনা মতে, গত ১৯ আগস্ট গ্রেফতার ইমন সেই শিক্ষকের সাথে দেখা করতে চান। এসময় ইমন ও ছাদেক তার বাসায় যান। কিন্তু সাগর অটোরিকশা নিয়ে শিক্ষকের বাসার আশেপাশে থাকেন। সাগর ও ইমন শিক্ষকের বাসায় অবস্থান করে তার সাথে গল্প-গুজব করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বিদ্যুৎ চলে গেলে ছাদেক তার গলা চেপে ধরেন এবং ইমন মুখ চেপে ধরেন। এরপর তারা তার গলায় গামছা পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
পরবর্তী সময়ে তারা কৌশলে শিক্ষক গোলাম কিবরিয়ার লুঙ্গি দিয়ে হাত-পা বেঁধে এবং গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে গোলাম কিবরিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। পরে ইমন নিহতের বিছানার নিচ থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুলে ছয় লাখ ৫০ হাজার টাকা, চারটি মোবাইলফোন লুট করেন। এই টাকার মধ্যে অটোচালক সাগরকে ৫০ হাজার এবং বাকি টাকা তারা ভাগ করে নেন। এরপর বিষয়টি ধামাচাপা দিতে শিক্ষক সমকামী ছিলেন এমন চিরকুট লিখে ফেলে রেখে তারা পালিয়ে যান।
গ্রেফতার ইমনের বাড়ি ঢাকার জিরানী এলাকায়। সেখানে তিনি পরিবারের সাথে ১৫ বছর ধরে বসবাস করছেন। তিনি এইচএসসি পাস করে একটি গার্মেন্টসে কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে কাজ করতেন। তবে তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে গাজীপুরের কাশিমপুর থানায় একটি ডাকাতি মামলা রয়েছে।
অন্যদিকে সাগর প্রায় ২০ বছর ধরে জিরানী ও সাভার এলাকায় বসবাস করছিলেন। তিনি অটোরিকশা চালাতেন। ২০১৯ সালে জিরানী এলাকায় বিশৃঙ্খলা, মাদক ব্যবসা ও অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরার কারণে এলাকাবাসী তাকে ও তার পরিবারকে এলাকা থেকে বের করে দিলে তিনি পরিবারসহ সাভারে ওয়াবদা রোডে এসে বসবাস শুরু করেন।
গ্রেফতার ছাদেক জিরানী এলাকায় থাকেন এবং জিরানী বাজারে একটি গামেন্টসে চাকরি করতেন।