*গ্রাহকের দায় পরিশোধের নামে ভিন্নখাতে ব্যয়ের অভিযোগ
*নিয়ম মেনেই সহায়তা দেওয়া হচ্ছে: কেন্দ্রীয় ব্যাংক
পতিত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতের লুটপাটের চিত্র ঢাকার একটি অন্যতম মাধ্যম ছিল দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহযোগিতা দেওয়া। বিপুল পরিমাণ টাকা ছাপিয়ে কয়েকটি ব্যাংককে নিয়মিত তারল্য সুবিধা দিতেন তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। কিন্তু সেই ধারা এখনও অব্যাহত দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ ঈদের আগেও পাঁচ ব্যাংককে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ধার দেওয়া হয়েছে। টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করা নিয়ে রীতিমতো লুকোচুরি খেলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়াও গ্রাহকের দায় পরিশোধের নামে এই টাকা নিলেও ধারের এসব টাকা ভিন্নখাতে ব্যয়ের অভিযোগ উঠেছে।
যদিও গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে কোনো দুর্বল ব্যাংকে টাকা ছাপিয়ে সহায়তা করা যাবে না। অথচ তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ব্যাংক বাঁচানোর নামে বারবার টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ দুর্বল ব্যাংককের গ্রাহক বারবরা ধর্না দিয়েও আমানতের টাকা ব্যাংক থেকে ফেরত পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, তীব্র তারল্য সংকটে ডিমান্ড প্রমিসরি (ডিপি) নোটের বিপরীতে ১০ শতাংশ সুদে ৯০ দিনের জন্য টাকা ছাপিয়ে ৫টি ব্যাংকে ধার দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত প্রচলিত জামানত না থাকায় কার্যত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘টাকা ছাপিয়ে’ এই সহায়তা দিয়েছে। তার মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকে ১ হাজার কোট টাকা, এবি ব্যাংকে ৫০০ কোটি, বেসিক ব্যাংকে ৫০০ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ৫০০ কোটি এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৫০০ কোটি টাকা।
গত ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এক সংবাদ সম্মেলনে গোপনে টাকা ছাপিয়ে ছয় দুর্বল ব্যাংকে সহায়তা করার কথা স্বীকার করেন। তিনি জানান, ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সহায়তা দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজন হলে আরও দেওয়া হবে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক। মূলত গোপনে টাকা দেওয়ার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল।
ওইদিন গভর্নর আরও বলেন, ‘আমি এতদিন বলেছিলাম টাকা ছাপাব না। কিন্তু সেটা থেকে সাময়িকভাবে সরে এসেছি। দুর্বল ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা টাকা তুলতে পারছেন না। গ্রাহকদের টাকা তোলার সুযোগ দেওয়ার জন্য ছাপানো টাকায় সহায়তা দেওয়া হয়েছে।’
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার বদলের পর ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়। তবুও তারল্য সংকটে ভুগছে। গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক জামানত ছাড়া ধার দেওয়ার প্রবণতা এখনও অব্যাহত রয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোকে গ্যারান্টারে মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকে ধারের ব্যবস্থা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বারবার সময় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কিন্তু সব দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ সামলাতে টাকা ছাপিয়ে টাকা ধার দিতে বাধ্য হচ্ছে। এর শেষ সমাধান এখনো অজানা।
তবে বাস্তবে গ্রাহকেরা সেই টাকার সুফল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করছেন। ন্যাশনাল ব্যাংকের রাজধানীর একটি শাখার গ্রাহক শামীমা জানান, ন্যাশনাল ব্যাংকে টাকা আমানত রেখে তুলতে পারছেন না। তারা বারবার সময় দেয় কিন্তু টাকা দেয় না। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা পেলে টাকা দেবে বলে এবার জানিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক সহায়তা দেয় গোপনে। যা ব্যাংক অন্যান্য কাজে ব্যয় করে। গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করে না। টাকাটা সংবাদ সম্মেলন করে দিলে গ্রাহক পরদিন ব্যাংকে গিয়ে আমানত ফেরত পেতেন। কিন্তু গোপনে দেওয়ার রহস্য আছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ দিলেও কোনো লাভ হবে না বলে জানায় ব্যাংকের শাখা কর্মকর্তারা।
ইউনিয়ন ব্যাংকের একটি শাখার গ্রাহক নজরুল বলেন, ব্যাংকে টাকা রেখে মহাবিপদে আছি। মাত্র ৫ লাখ তুলতে পারছি না। ব্যাংকের কাছে ১ লাখ টাকার চেক দিলেও তা ক্যাশ করেনি। যার কারণে কোরবানি দেওয়া হলো না। ব্যাংক ঈদের আগের কর্মদিবসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সহায়তা পেলে চেকটি ক্যাশ করবে। তারা টাকা ধার নিচ্ছে, কিন্তু কোনো টাকা দিচ্ছে না। নিশ্চয় টাকা অন্য কাজে ব্যয় করছে। নয়তো পছন্দের গ্রাহককে কোনো কিছুর বিনিময়ে টাকা দিচ্ছে।
একই অভিযোগ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক বায়োজিদের। আর এবি ব্যাংকও বড় গ্রাহকের টাকা দিতে পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রথম ধাপে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধার পায় দুর্বল ব্যাংক খ্যাত ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির মাধ্যমে ৯০ দিনের জন্য ১ হাজার কোটি টাকা ধার পায় ফাস্ট সিকিউরিটি, ইসলামী, এক্সিম, এনবিএল, এসআইবিএল। ধার দেয় মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি, ডাচ বাংলা, বেঙ্গল ও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। আর গত নভেম্বরে ৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা পায়। তারমধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৯২০ কোটি, এক্সিম ব্যাংক ৭০০ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংক ৪০০ কোটি এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ২৯৫ কোটি টাকা পেয়েছে। তারল্য সহায়তা দিয়েছে সেগুলো হলো, সোনালী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ইস্টার্ন, শাহজালাল ইসলামী, সিটি, ব্র্যাক, পুবালী, ঢাকা ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক।
এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কোনো কোনো ব্যাংকে তারল্য সংকট হয়েছে, তাদের টাকা ছাপিয়ে অর্থায়ন করা হয়েছে। এর ফলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা থাকে না। এর প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে। জিনিসপত্রের দাম উসকে যাওয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, নিয়ম কানুন মেনেই ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দেওয়া হয়। কিছু ব্যাংকে সহযোগিতা করা হয়েছে। কেননা, গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখতে এসব করা হয়েছে। গ্রাহকদের দায় পরিশোধ ছাড়া এই টাকা অন্য কোনো খাতে ব্যয় করার সুযোগ নেই।