সাবেক ওই সংসদ সদস্যের নাম আবুল কালাম আজাদ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসন থেকে সংসদ সদস্য হন। এর আগে বাগমারার তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র ছিলেন তিনি। সবশেষ নির্বাচনে কালাম এমপি হলে তার স্ত্রী খন্দকার শায়লা পারভীনকে অনেকটা ‘গায়ের জোরে’ তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র করেন। এলাকায় অবৈধভাবে পুকুর খননের জন্য ‘ভেকু কালাম’ হিসেবে তিনি পরিচিত।
জানা গেছে, গত বছরের ২ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়া থেকে আবুল কালাম আজাদকে র্যাব গ্রেফতার করে। পরদিন তাকে রাজশাহী এনে আদালতে তোলা হয়। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কালামের বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও পূর্বের খুনের অভিযোগসহ অন্তত হাফ ডজন মামলা রয়েছে। আটকের মাত্র সাড়ে তিন মাসের মাথায় জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যান তিনি। গত ২৯ জানুয়ারি তিনি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার খবরে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা জেলগেটে অবস্থান নেন। কালাম জেল থেকে বের হলে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাকে কারাফটক থেকে আবার গ্রেফতার করে।
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে বাগমারায় সশস্ত্র হামলা চালায় আওয়ামী লীগ। এ সময় কয়েকজন আন্দোলনকারীকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে গুরুতর আহত করে তারা। চালানো হয় গুলি। ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এসব ঘটনায় আবুল কালাম আজাদসহ আওয়ামী লীগের কয়েক শ নেতাকর্মীর নামে বাগমারা থানায় মোট ছয়টি মামলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, কালাম সাবেক এমপি হওয়ায় কারাগারে ডিভিশন পান। ফলে সাধারণ বন্দীদের চেয়ে বাড়তি সুবিধা পেতে থাকেন। সুযোগের অবৈধ ব্যবহারও করেন তিনি। জেলে বসে নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন তার বাইরের বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য। তৎপর হন অবৈধ কার্যকলাপেও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিনবার পৌরসভার মেয়র ও শেষবার সাত মাস এমপি থাকাকালে বাগমারায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন আবুল কালাম আজাদ। অলিখিত ‘সশস্ত্র গ্যাং’ তৈরি করে জমি, মাঠ-ঘাট ও পুকুর-বিল দখলে নেন তিনি। ২০০ বিঘা আয়তনের ৩০টি পুকুরের মালিকানা নেন। মাছ চাষ করেন ৫০০ বিঘা পুকুরে। টয়োটা কোম্পানির ল্যান্ড ক্রুজার ব্র্যান্ডের তার ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল দেড় কোটি টাকা দামের। সবমিলিয়ে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার মালিক হন তালিকাভুক্ত এই সন্ত্রাসী। পৌরসভায় কাজের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। এ নিয়েও দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। জলবায়ু তহবিলের জন্য আদায় করা ভ্যাট ও ট্যাক্সের ৫৫ লাখ ছয় হাজার ৭৮২ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে কালামের বিরুদ্ধে।
সূত্র বলছে, কারাগারে থেকেই পুকুর খনন ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছিলেন ভেকু কালাম। কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে দিয়ে এসব করিয়ে নিচ্ছিলেন। দুর্গাপুর উপজেলার উজানখলসি বিলের প্রায় দেড়শ বিঘা জমি গত বছর দখলে নেন তিনি। কালাম জেলে বসেই বেল্লাল হোসেন নামে স্থানীয় এক প্রভাবশালীকে দিয়ে পুকুর খনন শুরু করান। অভিযোগ পেয়ে সম্প্রতি অভিযান চালান দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিন। তবে অভিযানে গিয়ে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তাকে ফিরে আসতে হয়।
স্থানীয় এক বাসিন্দা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা বিশাল বড় প্রজেক্ট। আওয়ামী লীগের এমপি কালাম নির্দেশনা দিচ্ছে, যোগাযোগ করছে। বেল্লাল হোসেন দায়িত্বে থেকে পুকুর কাটছেন। ওখান থেকে হিউজ পরিমাণ টাকা নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের লোকজন তো ভিড়তে পারছে না, বিএনপির লোকজনের মাধ্যমে পুনরায় পুকুর খনন করা হচ্ছে।’
সূত্র জানিয়েছে, বাইরের জগত নিয়ন্ত্রণ ও যোগাযোগের জন্য কালামকে জেলের ভেতরে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তার বোন বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির একটি মোবাইল ফোন নিয়ে জেলখানায় তাকে দেখতে যান। সাক্ষাতের সময় ফোনটি কালামকে দেওয়ার জন্য তিনি এনেছিলেন। তবে তল্লাশির সময় কারারক্ষীর হাতে ধরা পড়েন। এরপর কারাগারে কালামকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কালাম তার বোনকে ফোন আনতে বলেছিলেন বলে স্বীকার করেন।
সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র জানায়, জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে দেশত্যাগ করে ভারত পালাতে নতুন কৌশল আঁটছেন সাবেক এমপি কালাম। গত ৯ মে তার কারাগার পরিবর্তন হয়েছে। রাজশাহী থেকে তাকে দিনাজপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে তিনি সেখানেই রয়েছেন। জামিন লাভের পর দিনাজপুর কারাগার থেকেই তিনি বের হবেন। এরপর দিনাজপুর থেকে হিলি বা আশপাশের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালাবেন তিনি। তাকে সহযোগিতা করছেন পুলিশের ও কারাগারের কয়েকজন কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক কতিপয় নেতা। এসব কাজ সম্পন্ন ও তাকে ভারত পালাতে সহযোগিতা করতে মোটা অংকের টাকা লেনদেন হচ্ছে বলেও সূত্রটি ঢাকা মেইলকে নিশ্চিত করেছে।
তবে জেল কর্তৃপক্ষ বলছে ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, অপরাধের কারণে কালামকে রাজশাহী থেকে দিনাজপুর কারাগারে বদলি করা হয়েছে। এ বিষয়ে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. শাহ আলম খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কারাগারে যারা থাকে, কারাগারের শৃঙ্খলা তাদের মানতে হবে। কালাম কারাগারের ডিসিপ্লিন ব্রেক করেছে। ব্রেক করার কারণে আমাদের আইজি স্যারের নির্দেশনাক্রমে তাকে আমরা দিনাজপুরে পাঠিয়েছি। পরবর্তী সময়ে এটা রিপোর্ট হয়েছে, তার ডিভিশন বাতিলের জন্য লেখা হয়েছিল।’
দিনাজপুরে কালাম কতদিন থাকবেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা অথরিটি ও সিচুয়েশনের ওপর নির্ভর করবে। তার মামলার হাজিরার জন্য যদি আনার প্রয়োজন হয়, তাহলে এখানে পাঠাবে আবার চলে যাবে। পরবর্তী স্টেপ তো এখন বলা যাবে না, ওটা পরবর্তী সময়ে বলা যাবে। আপাতত ওখানে পাঠানো হয়েছে। আর কোর্টও ভার্চুয়ালি চলে, সবসময় হাজির করারও প্রয়োজন পড়ে না।’
ঢাকার কোনো কারাগারে না পাঠিয়ে দিনাজপুরে পাঠানোর প্রশ্নে রাজশাহীর সিনিয়র জেল সুপার বলেন, ‘তাকে হাজিরার জন্য আনার প্রয়োজন হতে পারে। দিনাজপুর কাছাকাছি। আবার সব ঢাকায় এক জায়গায় পাঠালে সেখানে নানা কাহিনি করবে। তাই তাকে দিনাজপুরে পাঠানো হয়েছে।’
কালামের ভারত পালানোর পরিকল্পনার প্রশ্নে শাহ আলম খান বলেন, ‘এটার কি কোনো সুযোগ আছে? এ ধরনের কোনো আসামি বের হওয়ার আগে সে যেখান থেকে বের হোক, লোকাল সব সিকিউরিটি এজেন্সিকে ও ল-এনফোর্সিং এজেন্সিকে এটা ইনফর্ম করা হয়। ক্লিয়ারেন্স নিয়ে তারপরে ছাড়া হয়। ওইটার কোনো সুযোগই নাই। যারা বলে এগুলা না বুঝেই বলে।’
এ ব্যাপারে দিনাজপুর জেলা কারাগারের জেল সুপার মো. মতিয়ার রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পালানোর কোনো বিষয় আমাদের নলেজে নাই। আমরা তাকে রেস্ট্রিকশনে রাখছি। এখানে আসার পর পরিবারের সাথে তার যোগাযোগ হয়নি। উনার ডিভিশন বাতিল হয়েছে।’