চিফ অফিসারের মতো অন্য নাবিকরাও নিজের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন, বার্তা পাঠিয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়েছেন, বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন। তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত জলদস্যুরা কোনো মুক্তিপণ দাবি করেনি। জাহাজটি অপহরণের সঙ্গে জড়িত জলদস্যুদের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি জাহাজ মালিকপক্ষ। বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ এবং এর জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরো বিষয়টি নিয়ে খোঁজ রাখছেন। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ সভায় এ বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও হয়েছে।
জিম্মি নাবিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে স্বজন ও জাহাজের মালিকপক্ষ বলছে, জাহাজটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অন্তত ৫০ জন অস্ত্রধারী জলদস্যু। গতিপথ ঘুরিয়ে সেটিকে সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে জলদস্যুরা।
আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে মঙ্গলবার দুপুরে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজের ২৩ নাবিক এখন জলদস্যুদের হাতে জিম্মি। মুক্তিপণ না দিলে জলদস্যুরা তাদের একে একে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে বলেও স্বজনদের জানিয়েছেন নাবিকরা। জাহাজটির মালিক কবির গ্রুপের এসআর শিপিং। এই কোম্পানির একটি জাহাজ (এমভি জাহানমণি) ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। ওই সময় ২৬ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল। ১০০ দিন পর তাদের মুক্ত করে এনেছিল কোম্পানি।
গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, হাইজ্যাক হওয়া জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও ২৩ নাবিককে উদ্ধারে সোমালীয় জলদস্যুদের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করা যায়নি। তবে নাবিকদের উদ্ধার তৎপরতা চলছে। মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সেকেন্ড পার্টির মাধ্যমে চেষ্টা করছি এবং যেখানে জানানো প্রয়োজন, আমরা সেখানে জানিয়েছি।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে রিপোর্টিং সেন্টার ইন কুয়ালালামপুর, ইন্ডিয়ান ফিউশন সেন্টার ইন নিউ দিল্লি, তারপর সিঙ্গাপুর, ইউএসএ, ইউকে, চায়নাসহ সব এরিয়াল নেভাল শিপে আমরা রিপোর্ট করেছি। অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমেও আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।’
হাছান মাহমুদ বলেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে অত্যন্ত কনসার্ন। বিষয়টি মন্ত্রিসভায়ও অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছে।’
জাহাজসহ জিম্মি নাবিকদের কীভাবে মুক্ত করা হবে এবং জলদস্যুদের কোনো মুক্তিপণ দেওয়া হবে কি না—এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই জাহাজকে এবং নাবিকদের মুক্ত করা। কৌশল কী হবে, এটা ইন পাবলিক (প্রকাশ্যে) বলার বিষয় নয়। তা ছাড়া এর আগে একই কোম্পানির একটি জাহাজ জলদস্যুরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। তিন মাস পর সেই জাহাজ এবং ক্রুদের উদ্ধার করা হয়েছিল।’
এদিকে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে সরকার বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন সুস্থভাবে তাদের ফিরিয়ে আনার সব ব্যবস্থা করার জন্য। আমরা কাজ করছি। তবে নির্দিষ্ট করে সময় বলা যাচ্ছে না।’
জলদস্যুদের হাতে জিম্মি ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজের নাবিকদের মুক্ত করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌবাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সব পর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলেও জানান নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের শিপিং ব্যবস্থা এখন বিশ্বের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। মঙ্গলবার আমরা যখন এ বিষয়টি অবহিত হয়েছি, তখন তাৎক্ষণিকভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আন্তর্জাতিক যতগুলো উইং নৌ পরিবহনের কাজ করে, সবার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। নৌবাহিনীর আন্তর্জাতিক যোগাযোগ অনেক বেশি, আমরা তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি।’
গতকাল দুপুরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক যৌথসভায় সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজের ২৩ নাবিকের সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘নাবিকরা এখনো নিরাপদ ও সুস্থ আছেন। তবে জাহাজ এখন জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে আছে। আমাদের প্রথম গুরুত্ব হলো যারা নাবিক আছেন এবং সঙ্গে অন্য কেউ থাকলে তাদের জীবন নিরাপদ রাখা। নাবিকদের রক্ষা করা, উদ্ধার করা।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যেসব জলদস্যু জাহাজকে আটকে রেখেছে, জাহাজ এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণেই আছে। আমরা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি।’
যা বলছে মালিকপক্ষ:
জলদস্যুদের কাছে জিম্মি থাকা ‘এমভি আবদুল্লাহ’র মালিকপক্ষ কবির গ্রুপ জানিয়েছে, তারা দস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ওদিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। গতকাল বিকেলে জাহাজের মালিক এসআর শিপিংয়ের মূল কোম্পানি কবির গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পার্সন মিজানুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে তারা জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। এখনো কোনো যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, ‘জলদস্যুদের একটা কৌশল হলো জাহাজ ক্যাপচার করার পর তারা সেইফ জোন তৈরি করে। তারপর সেখান থেকে নিজেদের ডিমান্ড জানায়। এখন পর্যন্ত জলদস্যুরা তাদের কোনো ডিমান্ড আমাদের জানায়নি।’
মিজানুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমাদের প্রথম প্রায়োরেটি হলো নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় মুক্ত করা। তারপর জাহাজ অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা। এক্ষেত্রে আমাদের আগের একটি অভিজ্ঞতা আছে। সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা এটাও উদ্ধার করতে পারব বলে আশা করছি।’
জাহাজটির সর্বশেষ অবস্থান কোথায়:
ঢাকায় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গতকাল ভোর ৪টা ২৮ মিনিটে জাহাজটি উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে সোমালিয়া উপকূলের দিকে যাচ্ছিল। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম গতকাল জানিয়েছেন যে, এমভি আবদুল্লাহ উত্তর-পশ্চিমমুখী হয়ে সোমালিয়া উপকূলের দিকে ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী থেকে সর্বশেষ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের যে অবস্থান জানা গেছে, তা জানিয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, মঙ্গলবার দুপুর ১টা ৩৩ মিনিটে জাহাজটি উপকূল থেকে ৫৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল। আজ (গতকাল) সকাল ৬টা ৩৮ মিনিটে উপকূল থেকে ৪৮০ নটিক্যাল মাইল দূরে এসেছে। অর্থাৎ জাহাজটি ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে সোমালিয়ার দিকে।
ভয় ‘কৌল কার্গো’ নিয়ে, প্রয়োজন বিশেষজ্ঞের মতামত:
হাইজ্যাক হওয়া জাহাজে কিছু কৌল কার্গো আছে, যেগুলো ভয়ের কারণ বলে মনে করছেন জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান। অডিও বার্তায় তিনি এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের জাহাজে কিছু কৌল কার্গো (কয়লা) আছে। প্রায় ৫৫ হাজার টন। এগুলো একটু ডেঞ্জারাসও। ফায়ারেরও ঝুঁকি আছে। মিথেন বাড়ে। লাস্ট যখন অক্সিজেন মেপেছি তখন ৯ থেকে ১০ শতাংশ লেভেল পেয়েছি। এটি নিয়মিত মনিটরিং করতে হয়। কোনো কারণে অক্সিজেন লেভেল বেড়ে গেলে বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে। এটার একটু ব্যবস্থা করবেন, স্যার।’
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন বলেন, জাহাজের ডেক ক্যাডেট হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজটি পাঠান আমাদের সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেখারুল আলমের কাছে। এর পর মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে চিফ ইঞ্জিনিয়ার আরেকটি মেসেজ দিয়েছেন মালিকপক্ষের প্রধান নির্বাহীর কাছে। সেখানে তারা নিরাপদে আছেন বলে জানিয়েছেন। বুধবার সকালে সোমালিয়ার উপকূল থেকে জাহাজটি প্রায় ৩০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল। সন্ধ্যার পর তার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, বিপদে আছে। মুক্তিপণ না পেলে জলদস্যুরা তাদের মেরে ফেলবে।
জাহাজে ২৫ দিনের খাবার আছে:
জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিকউল্লাহ খানের অডিও বার্তা থেকে জানা যায়, জাহাজে ২৫ দিনের মতো খাবার রয়েছে। এ ছাড়া জাহাজটিতে বিশুদ্ধ পানি রয়েছে ২০০ টন। মঙ্গলবার তিনি এ বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সে হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার ২৩ দিনের খাবার রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন (ইউকে এমটিও) তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল পূর্বে এ ঘটনা ঘটেছে। দুটি নৌযানে (একটি বড় এবং আরেকটি ছোট) চড়ে জাহাজটির কাছাকাছি এসে জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ইউকে এমটিও সমুদ্র চলাচলকারী অন্য জাহাজগুলোতে সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করতে বলেছে।
নাবিক আসিফুরের ভিডিও ভাইরাল:
জলদস্যুরা জাহাজে উঠছে, এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করেন জিম্মি নাবিক আসিফুর রহমান। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় ওই ভিডিও তিনি পোস্ট করেছেন। এতে দেখা যায়, ছোট্ট একটি নৌযান থেকে রশি বেয়ে একজন জলদস্যু জাহাজটিতে উঠছে।
আসিফুরের বোনের স্বামী সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, আসিফুরের কাছে দুটি মোবাইল ছিল। জলদস্যুরা প্রথমেই একটা নিয়ে ফেলে। আরেকটি ফোন থেকে আসিফুর ফোন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইফতার করার জন্য জলদস্যুরা তাদের একটা কক্ষে নিয়ে গেছে। তবে কারও কোনো ক্ষতি করেনি।
জিম্মি আরেক নাবিকের পাঠানো অডিওতে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘ওরা (জলদস্যুরা) একটা স্পিডবোট উঠিয়েছে ওপরে। ডিজেল নিয়ে গেছে। আমাদের বোটে উঠিয়েছে সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
উদ্বিগ্ন স্বজনরা ছুটছেন মালিকপক্ষের দ্বারে:
ছেলের ছবি হাতে নিয়ে জাহাজ কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটে এসেছেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চতুর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদের মা জোৎস্না বেগম। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘আমার মানিক কোথায়? তারে আমার সামনে আনেন। আমি আমার মানিকরে বুকে নেব।’ সেখানে ছিলেন জিম্মি হওয়া নাবিকদের আরও কয়েক স্বজন। তাদের কেউ এসেছেন ভাইয়ের খোঁজে, কেউ স্বামীর।