শীত ও বর্ষায় ঝুপড়ি দোকানের পাশে কেটে যায় তার দিন, রাত ও বছর। জীবনের এই পড়ন্তবেলায় এসে চলতি পথে যাকেই দেখেন, নিজের বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধার করে এনে দিতে আকুতি করেন, যাতে ছেলেদের কাছে ফিরতে পারেন।
বাগেরহাট শহরের সাহাপাড়া স্কুল-সংলগ্ন একটি দোকানের সামনে কয়েক বছর ধরে বসবাস করছেন গোলেনুর বেগম।
গোলেনুর বেগম বলেন, অনেক বছর আগে বাবার সঙ্গে ঝালকাঠি থেকে বাগেরহাটে আসি। এখানে জেলখানায় রান্নাবান্নাসহ ধোয়ামোছার কাজ করতাম। পাশাপাশি মানুষের বাড়িতেও কাজ করেছি। অল্প অল্প করে জমানো টাকা দিয়ে সদর উপজেলার বাদেকাড়াপাড়া এলাকায় চার কাঠা জমি কিনি কয়েক বছর আগে। কিন্তু আমারে আমার জমিতে যাইতে দেয় না এয়ার খান, চান মিয়াসহ কয়েকজন। আমি আমার জমি ফেরত চাই। আমার দেশের বাড়ি (ঝালকাঠি) ফিরতে চাই।
এই দোকানে কেন থাকেন, এমন প্রশ্নে গোলেনুর বেগম বলেন, আমার ছোট ছেলেই আমাকে এখানে রেখে গেছে। তবে ছেলেরা মায়ের খোঁজ না রাখলেও গোলেনুর বেগমের কোনো অভিযোগ নেই তাদের প্রতি। ছেলেদের সম্পর্কে বলেন, আমার ছেলেরা খুব ভালো, কিছুদিন পরেই আমি ওদের কাছে চলে যাব। ওরা আমারে খুব ভালোবাসে। আমার বউমাও অনেক ভালো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোলেনুর বহু বছর আগে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে এয়ার খান নামের এক মুহুরি ও স্থানীয় চান মিয়ার সহযোগিতায় একটি জমি কেনেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার জমি বেদখল হয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, এয়ার খান সেই জমি কিনতে সহযোগিতা করলেও তিনিই আবার অন্যত্র বিক্রি করে দেন জমি। যেহেতু গোলেনুর অসহায়, সে ক্ষেত্রে তিনি ন্যায় বিচার পাবেন কি না, সে বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা।
স্থানীয় ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খাবার, বস্ত্র, পাঁচ-দশ টাকা দিয়ে সহায়তা করেন গোলেনুর বেগমকে। তাদের এই সামান্য সহায়তাতেই কোনোমতে খেয়েপরে বেঁচে আছেন তিনি।
আবুল কালাম আকন নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই তিনি (গোলেনুর বেগম) আমাদের এখানে এই দোকানের সামনে বসবাস করেন। আমরা এলাকাবাসী সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করি। শুনেছি তার বাদেকাড়াপাড়া এলাকায় একটি জমি আছে। কিন্তু জমিটি কয়েক ব্যক্তি দখল করে নিয়ে যায়।
শহিদুল ইসলাম নামের অন্য এক বাসিন্দা বলেন, বৃদ্ধ এ দাদিকে মাঝেমধ্যেই দেখি কাঁদতে। কাঁদার কারণ জানতে চাইলে বলেন, এখানে থাকতে খুব কষ্ট হয় তার। কখনো ছেলেদের কাছে যেতে চান আবার কখনো যাবেন না বলে জানান। আসলে তার একটি স্থায়ী থাকার জায়গার প্রয়োজন। এই অবস্থায় সরকারি ও সমাজের বিত্তবানদের প্রতি গোলেনুর বেগমকে সাহায্যের আবেদন জানান শহিদুল।
সাহাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেলিনা সুলতানা বলেন, বৃদ্ধা মহিলা অনেক দিন ধরেই এখানে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। তার কোনো আত্মীয়স্বজনকেও দেখিনি এখানে আসতে। তবে এই শীতে যদি একটু ভালো জায়গায় থাকার ব্যবস্থা না করা যায়, তবে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চান মিয়া বলেন, গোলেনুর বিবি প্রথমে জমি কিনলেও পরে এয়ার খানের কাছে বিক্রি করে দেন। কিন্তু এয়ার খান সম্পূর্ণ টাকা দেননি। এখনো ২০ হাজার টাকা তার কাছে পাওনা রয়েছেন।
গোলেনুরের সঙ্গে কোনো দেনা-পাওনা নেই দাবি করে এয়ার আলী খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গোলেনুর বিবি ২০০৩ সালে গোবরদিয়া মৌজায় ১০ শতক জমি কেনেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও দখল নিতে না পারায় ২০১৩ সালে আমার কাছে জমিটি বিক্রি করে দেন। আমি তখন চুক্তি অনুযায়ী সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করি। পরবর্তীতে জমিটি অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছি। কিন্তু এত বছর পরে এসে তিনি বিক্রি করে দেওয়া জমি কেন দাবি করছেন, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। মানবিক কারণে তার কোনো সাহায্য প্রয়োজন হলে কিছু সাহায্য করতে পারি। কিন্তু জমি-সংক্রান্ত কোনো দেনা-পাওনা আমাদের মধ্যে নেই। যদি কেউ এ ধরনের কথা বলে থাকে, তবে তিনি ভুল বলেছেন।
সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভীন বলেন, আমরা অসহায় গোলেনুর বেগমের কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নিয়ে বাদেকাড়াপাড়া এলাকায় সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি এবং অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। শিগগরিই সব পক্ষকে নিয়ে বসব, যাতে গোলেনুর বেগম তার প্রাপ্য জমি ফিরে পান।
বাগেরহাট সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম আজিজুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। যদি ভদ্র মহিলা থানায় অভিযোগ দেন, আমরা তাকে আইনগত সহায়তা প্রদান করব।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, গোলেনুর বেগম নামের এক বৃদ্ধার অসহায়ত্বের খবর আমরা শুনেছি। আমরা তার বিষয়ে খোঁজখবর নেব। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গোলেনুর বিবিকে আইনের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা।