শেষ বাঁশিটা বাজতেই ক্যামেরা গিয়ে পড়ল কোচ গ্যারেথ সাউথগেটের ওপর। উদযাপন তো ছিলই, কিছুটা স্বস্তিও কি মিশে ছিল না তাতে? ২৫ বছর আগে এই জার্মানির বিপক্ষে যে দুঃসহ স্মৃতি উপহার পেয়েছিলেন, সেটা পেছনে ফেলা হয়নি এ জয়ে? খেলোয়াড় হিসেবে যে নকআউট জয়টা পাননি জার্মানির বিপক্ষে, সেই অধরা জয়টাই মিলল এবার। ইউরো ২০২০ এর শেষ ষোলয় জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করেছে ইংল্যান্ড।
প্রথমার্ধে শ্রেয়তর দল হয়েও ইংলিশরা পাচ্ছিল না গোলের দেখা। দ্বিতীয়ার্ধে জার্মানরা যেন কিছুটা পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেল। খেলাটা হয়ে গেল সমানে সমান। তাই সময় যত বাড়ছিল, ওয়েম্বলিতে দুর্ভাবনাও বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। ইংলিশদের ইউরো ইতিহাসটা সুখকর নয়, বিশেষ করে এই জার্মানির বিপক্ষে এই ওয়েম্বলির মাটিতেই যে আছে হারের দ্গদগে স্মৃতি! দুর্ভাবনা না বেড়ে যায় কোথায়?
কোচ গ্যারেথ সাউথগেট খানিকটা রক্ষণাত্মক নিরাপত্তা চাইছিলেন সেই ২০১৮ বিশ্বকাপের পর থেকেই। ইউরোর আগে ৩-৪-৩ ছকে থিতু করেছিলেন দলকে। কিন্তু তাতে দলের গোলস্কোরিং ফর্মে যেন পড়ল একটু ছেদ।
তাই জিততে ইংল্যান্ডের আজকাল একজন নায়কের প্রয়োজন হয়, যিনি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল করে থ্রি লায়ন্সদের পার করিয়ে দেন বাধার বিন্ধ্যাচল। গ্রুপপর্বে সে নায়কটা ছিলেন রাহিম স্টার্লিং। আজ যখন জার্মানদের বিপক্ষে দলের দারুণ প্রয়োজন পড়ল, তখনো সাড়া দিলেন তিনিই। শেষ বাঁশির ১৫ মিনিট আগে করলেন গোল। তাতে মহাগুরুত্বপূর্ণ লিডটাও পেল ইংলিশরা।
নির্ধারিত সময়ের ৫ মিনিট আগে আবারও জার্মান বিপৎসীমায় ইংলিশদের হানা। গোল করলেন হ্যারি কেইন, বড় প্রত্যাশা নিয়ে ইউরোয় এসেও যিনি পাচ্ছিলেন না গোলের দেখা সেই হ্যারি কেইন। ওয়েম্বলিতে হাজির ইংলিশ সমর্থকরা তখন রীতিমতো সপ্তম স্বর্গে। যাবেনই না কেন, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যে ইউরো নকআউটে নির্ধারিত ৯০ মিনিটেই জয় তুলে নিয়েছে দল!
এর আগে সেয়ানে সেয়ানে লড়াইটায় ফলাফল হেলে পড়তে পারত যে কোনো দিকেই। দুটো বড় সুযোগই পেয়েছিল জার্মানি। শেষটা ছিল এমন সময়ে, যখন ‘ডি ম্যানশ্যাফটরা’ ছিল পিছিয়ে। কিন্তু কাই হ্যাভার্টজের স্কয়ার করা বলটা থেকে থমাস মুলারের শটটা বেরিয়ে গেছে গোল পোস্টের অনেক বাইরে দিয়ে। ফলে সমতা আর আনা হয়নি জার্মানির, হেরেছে ম্যাচটাও।
জার্মান কোচ জোয়াকিম লো আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, এই ইউরোই শেষ। এরপর আর তার পায়ের চিহ্ন পড়বে না জার্মান ডাগআউটে। সেই জার্মানদের ডাগআউটে তিনি এদিন দাঁড়িয়েছিলেন ১৯৮তম ম্যাচে। ডাবল সেঞ্চুরি থেকে ছিলেন দুই ম্যাচের দূরত্বে। কিন্তু দলের হার তার ক্যারিয়ারে যতি চিহ্ন ফেলে দিয়েছে তার আগেই।
ঠিক বিপরীত চিত্র ইংলিশ ডাগআউটে। গ্যারেথ সাউথগেট পেয়েছেন দুঃসহ এক স্মৃতি থেকে মুক্তি। ১৯৯৬ ইউরোয় এই জার্মানির বিপক্ষে, এই ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামেই পেনাল্টি শুটআউটে নিয়েছিলেন দুর্বল এক পেনাল্টি। সেটাই হারিয়েছিল দলকে, নিজে রীতিমতো বনে গিয়েছিলেন জাতীয় শত্রু। পরের বিশ্বকাপে দলে ছিলেন, কিন্তু মাঠে নামতে পারেননি এক মিনিটের জন্য। সেই সাউথগেটের কল্যাণেই এবার ইংলিশরা চলতি শতাব্দিতে প্রথমবারের মতো জিতল কোনো ইউরোপিয়ান নকআউট লড়াই।
হ্যাঁ, সাউথগেটের কল্যাণেই তো। ম্যাচের তখন আধঘণ্টার মতো বাকি। নির্ধারিত সময়ে খেলাটা শেষ করে দিতে দুই কোচই আনলেন পরিবর্তন। জার্মান দলে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে এলেন সের্জ গেনাব্রি, আর ইংল্যান্ড দলে কোচ সাউথগেট আনলেন জ্যাক গ্রিলিশকে।
গেনাব্রির প্রভাব চোখে পড়ার মতো না হলেও, গ্রিলিশ যেন বদলে দিলেন ইংল্যান্ডকে। এতক্ষণ শত আক্রমণেও কাজ না হওয়া ব্রিটিশরাই ৭৫ মিনিটে পেল গোলের দেখা। যেটা গড়ে দেওয়ার কাজটা করেছিলেন এই গ্রিলিশ। পরে হ্যারি কেইনের গোলে তো দিলেন সরাসরি যোগানই। কোচ সাউথগেটও যেন পেয়ে গিয়েছিলেন ২৫ বছর আগের সে দুঃসহ স্মৃতি থেকে মুক্তি।
ওয়েম্বলির দর্শক তখন যেন পাগলপারা! গ্যালারিতে তখন কোরাসে চলছে ‘ইটস কামিং হোম’ স্লোগান। ১৯৬৬ সালে যখন সর্বপ্রথম ও সবশেষবার ফুটবল ‘ঘরে এসেছিল’, সেবারই সর্বশেষ ওয়েম্বলির মাটিতে কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে ইংল্যান্ড হারিয়েছিল জার্মানদের, এরপর আর কখনো হয়নি এমন কিছু। সেবার ফুটবল ‘ঘরে ফিরেছিল’, তবে কি এবারও?