দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব কমলেও জাতীয় পার্টির (জাপা) সংকট কাটছে না চাচা-ভাতিজার বিরোধে। দলীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনে জি এম কাদেরের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা স্থগিতের বিরুদ্ধে আপিল করা হয় তাঁর ভাতিজা রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদের অনুমোদনে। এতে আবারও নিষেধাজ্ঞায় পড়েছেন জি এম কাদের। জাপা সূত্রের খবর, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের অনুসারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁর ছেলে সাদ এরশাদ। রওশনকে সামনে রেখে সাদ এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন জি এম কাদের জমানায় জাপা থেকে বহিস্কার ও বাদ পড়া নেতারা। তাঁরা রওশনকে দিয়ে দলের মহাসচিব বদল করতে চান। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমৃত্যু রংপুর-৩ আসনের এমপি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে এই আসনে এসএম ইয়াসিরকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন জি এম কাদের। কিন্তু রওশনের অনড় অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পান সাদ এরশাদ। জাপা ঘোষণা দিয়েছে, আগামী নির্বাচনে রংপুর-৩ আসনে প্রার্থী হবেন জি এম কাদের। এতে ক্ষুব্ধ বর্তমান এমপি সাদ এরশাদ। চাচা-ভাতিজার দ্বন্দ্বে দেবর-ভাবির বিরোধ মিটেও মিটছে না। যদিও এসব বিষয়ে সাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জাপার কয়েকজন নেতা রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরাই এসব তথ্য জানিয়েছেন সমকালকে। তাঁদের প্রচেষ্টায় সমঝোতা বৈঠকের পরও বিরোধ না মেটায় হতাশা প্রকাশ করেছেন।
জাপা সূত্রের খবর, দু’পক্ষেরই কয়েকজন নেতা সমঝোতার বিরোধী। সমঝোতার প্রচেষ্টা চালানো জাপার এক কো-চেয়ারম্যান এ বিষয়ে সমকালকে বলেছেন, ঐক্য বিরোধীদের একমাত্র উদ্দেশ্য দলকে ভেঙে নিজে এমপি হওয়া। দল ঐক্যবদ্ধ থাকলে তাঁরা কেউ প্রথম সারিতেই থাকতে পারবেন না। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো জোট থেকে মনোনয়ন পাবেন না।
থাইল্যান্ডে দীর্ঘ পাঁচ মাস চিকিৎসা শেষে গত রোববার দেশে ফেরেন জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন। তাঁর অনুসারীরা দাবি করেছিলেন, দেশে ফিরে জাপার রাজনৈতিক পথনির্দেশ এবং রংপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে পাল্টা মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করবেন তিনি। এতে দেবর-ভাবির বিরোধ আরও বাড়ার শঙ্কা ছিল। কিন্তু দেশে এসে ঐক্যের কথা বলেন রওশন এরশাদ। জি এম কাদেরের সঙ্গেও আলোচনায় বসার কথা বলেন। গত মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেন জি এম কাদের। তাঁরা এক টেবিলে নাশতা করেন। এর ঘণ্টা দুই পর খবর আসে, চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনে জি কাদেরের ওপর বিচারিক আদালতের নিষেধাজ্ঞা হাইকোর্টে স্থগিত হয়েছে।
দাবি করা হয়, বিরোধ মিটে গেছে। জি এম কাদেরও সমকালকে বলেন, রওশন এরশাদকে পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর ভুল ভেঙেছে। তিনি অধিকাংশ বিষয়ে একমত হয়েছেন। তিনি কোনো দাবি-দাওয়া জানাননি। তবে রওশনপন্থিরা বৈঠকের বিষয়ে নীবর ছিলেন। সব বিষয় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে জানালেও মঙ্গলবারের বৈঠকের বিষয়ে কিছুই জানায়নি বিরোধীদলীয় নেতার প্রেস উইং। গুঞ্জন ছিল, রওশনের নমনীয়তায় খুশি নন তাঁর অনুসারীরা। যাঁরা জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা থেকে বাদ পড়েছেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর প্রতিফলন দেখা যায়।
রওশনের পক্ষ নিয়ে জাপার পদ থেকে অব্যাহিত পাওয়া সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধার মামলায় বিচারিক আদালতে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিলেন জি এম কাদের। দেবর-ভাবির বৈঠক এবং সমঝোতার খবরে ধারণা করা হয়েছিল, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে না। কিন্তু গতকাল আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করা হয়। এতে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। জিয়াউল হক সমকালকে বলেছেন, ‘রওশন এরশাদ আমার নেতা। আমি কি আর ম্যাডামের (রওশন) অনুমতি ছাড়া আপিল করেছি? সমঝোতা হলে কি আপিল করতাম?’
রওশন এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা কথা হয়েছি কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, “সাদ এরশাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়। সাদ টেলিফোনে ম্যাডামকে (রওশন) ধরিয়ে দেন। সাদ বলেছেন, ‘মামলা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আইনি অধিকার। আপিল করা উচিত।’ ম্যাডামও একই কথা বলেছেন।” তবে রওশন এরশাদের মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশিদ সমকালকে বলেছেন, মামলা জিয়াউল হকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এর সঙ্গে রওশন এরশাদের সংশ্নিষ্টতা নেই। বহিস্কারের বিষয়ে আইনি প্রতিকার চাওয়ার তাঁর অধিকার রয়েছে। থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৩১ আগস্ট চিঠি দিয়ে দলের কাউন্সিল ডাকেন রওশন এরশাদ। উদ্দেশ্য ছিল সরকার, নির্বাচন ব্যবস্থা ও দুর্নীতি ইস্যুতে সমালোচনামুখর জি এম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানো। নিজেকে আহ্বায়ক করে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেন তিনি। গুঞ্জন রয়েছে, রওশনের অজ্ঞাতেই কাউন্সিল আহ্বান করা হয়েছিল। যদিও পরে কাউন্সিল স্থগিত করা হয়।
গত জুনে বাজেট অধিবেশনে যোগ দিতে সাত মাস পর রওশন যখন দেশে ফেরেন, তখনই তাঁকে ঘিরে জাপা থেকে বাদ পড়া নেতাদের একটি বলয় গড়ে ওঠে। সূত্রের খবর, জি এম কাদেরবিরোধী এই বলয়টি সরকারি সমর্থন পাচ্ছে। বিএনপির সুরে কথা বলা জি এম কাদেরকে চাপে রাখতেই সমর্থন দেওয়া হচ্ছে। সাদ এরশাদ এই বলয়ের মূল নেতা।
জিয়াউল হক মৃধার অভিযোগ, মঙ্গলবারের বৈঠকে রওশন এরশাদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করলেও জি এম কাদের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্যদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। অপমানজনক কথা বলেন। রওশনকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে যাননি জি এম কাদের। জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু জানিয়েছিলেন, দলের কেউ যাবেন না। কিন্তু জাপার কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম বিরোধীদলীয় নেতাকে স্বাগত জানান বিমানবন্দরে। দলটির দুই পক্ষই জানিয়েছে, এই চার নেতাসহ আরও কয়েকজন সমঝোতার চেষ্টা করছেন। দেবর-ভাবির বৈঠকে ছিলেন শফিকুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘জি এম কাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলেননি। এগুলো মিথ্যা অজুহাত। যারা ষড়যন্ত্র করছে, এগুলো (আপিল করানো) তাদের কাজ। ম্যাডাম (রওশন) এমন নোংরামি করার মানুষ নন।’
রুহুল আমিন হাওলাদার বলেছেন, যা হয়েছে দুর্ভাগ্যজনক। দলের দুই শীর্ষ নেতা একসঙ্গে বসেছেন। দলে ঐক্য প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। সেই সময়ে এমন কাজ অনুচিত। আগামী বছর নির্বাচন। এখন দলকে বিভক্ত নয়, ঐক্যবদ্ধ করার সময়। কিছু অসুস্থ মানসিকতার মানুষ পেছন থেকে ছুরি মারছে। জাপা সূত্রের খবর, রওশনপন্থিরা মুজিবুল হক চুন্নুকে মহাসচিব পদ থেকে সরাতে চান। রওশন ও জি এম কাদেরের আলোচনায় মহাসচিব প্রসঙ্গ না এলেও খবর ছড়ানো হয়- রওশন মহাসচিব বদল চান। এই সূত্রের তথ্য, রওশন ঘোষিত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব গোলাম মসীহকে মহাসচিব পদে চান রওশনপন্থিরা। তা না হলে রুহুল আমিন হাওলাদারকে চান। যদিও রুহুল আমিন বলেছেন, মহাসচিব হতে চান না। দলে ঐক্য চান।
রওশনপন্থি সূত্রের যুক্তি, মুজিবুল হক চুন্নু মহাসচিব হওয়ার পর জাপা সরকারবিরোধী হয়ে উঠছে। জি এম কাদের সরকারের কড়া সমালোচকে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের ভাষ্য, মুজিবুল হকের খপ্পরে পড়েছেন জি এম কাদের। তিনিই রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরানোর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন।