জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আকর্ষণ অন্যগুলোর চেয়ে একটু ভিন্ন। এ দিন রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে রুপ নেয় যেন ক্রীড়াঙ্গনের চাঁদের হাটে। নানা খেলার নানা গুণীজনের অন্যরকম এক মিলন মেলা চোখে পড়ল।
মিলনায়তনের প্রবেশ পথেই আট বছরের ৮৫ জনের ছবি সম্বলিত বোর্ড। পুরস্কার প্রাপ্তদের অনেকেই সেই বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ফ্রেমবন্দী করলেন। পুরস্কার পদক পাওয়ার পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও বিশেষ মুহূর্তের স্মৃতি ধরে রাখলেন অনেকে। বয়স, পদের বেড়াজাল ভেঙে পদকপ্রাপ্তদের অনেকে তুললেন গ্রুপ ভিত্তিক ছবি; কেউ আবার নিজ ডিসিপ্লিনের সাথে আবার কেউ স্কুল, জেলার সতীর্থদের সঙ্গে ফ্রেমবন্দী হলেন। বিশেষ এই দিনে আনন্দ উদযাপনের উপলক্ষ্য একেক জন খুঁজেছেন একেকভাবে।
দেশের এখন সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খেলা আরচ্যারি। সেই খেলায় এক দশকের বেশি সময় সভাপতির দায়িত্বে অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল মইনুল ইসলাম। অনেকটা শূন্য থেকে শুরু করে এখন অলিম্পিকে পদক জয়ের সম্ভাবনার জায়গায় আরচ্যারি। নিজের এই পুরস্কারপ্রাপ্তির মাধ্যমে আরো ভালো কাজের অনুপ্রেরণা খুঁজছেন মইনুল, ‘যে কোনো স্বীকৃতি অনুপ্রেরণার। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার আরো ভালো কিছুর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।’
জালাল ইউনুস নিজে এক সময় ক্রিকেট খেলেছেন। পরবর্তীতে ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন। চার দশকের বেশি সময় ক্রীড়াঙ্গন থাকার পর মিলল স্বীকৃতি। কিছুটা দেরিতে হলেও এই সম্মাননা পেয়ে সন্তুষ্ট এই ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, ‘বাংলাদেশে সকল ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের স্বপ্ন থাকে একদিন ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়ার। সর্বোচ্চ এই পুরস্কার পাওয়ায় ভালো লাগছে। ক্রীড়াঙ্গন এবং বিশেষত ক্রিকেটের প্রতি দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল।’
প্রধানমন্ত্রী আজকের অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন। তার বক্তব্যে বেশ কয়েকবারই আবাহনী ক্লাবের কথা উঠে এসেছে। আবাহনী ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত ডিরেক্টর ইনচার্জ কাজী নাবিল আহমেদ সংগঠক হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কার পাওয়ার পর আবাহনীর প্রতি আরো বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার কথাই বললেন, ‘বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আবাহনীর অবদান অনেক। এই ক্লাবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আবাহনী ক্লাবের উত্তরোত্তর সাফল্যের জন্য আরো বেশি নিবেদিত হব।’
সত্তর-আশির দশকে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। সেই সময়ের অন্যতম তারকা কাজী আনোয়ার ও খন্দকার রকিবুল ইসলাম। তাদের সমসাময়িক এবং জুনিয়র অনেকেই এই পুরস্কার আগে পেয়েছেন। পুরস্কারপ্রাপ্তির দিনেও সাবেক এই দুই ফুটবলারের কণ্ঠে খানিকটা বিলম্বের আক্ষেপ, ‘সরকার আমাদের সম্মান করেছে এজন্য কৃতজ্ঞ। তবে এটা আরো আগে হলে আরো সুন্দর হতো।’
পুরস্কার প্রদান প্রক্রিয়া অনেকটা বিলম্ব ও দীর্ঘায়িত হয়। অনেকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হলেও পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান না হওয়ায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। আজ বেশ কয়েকটি পুরস্কার মরণোত্তর হয়েছে। সংগঠক আফজালুর রহমান সিনহার পুরস্কার গ্রহণ করেছেন তার সতীর্থ জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘জীবিত থাকতেই এই পুরস্কার প্রদান করা উচিত। তাহলে সবাই সবার জীবদ্দশায় একটি প্রশান্তি পায়।’
এবারের পুরস্কারে খেলোয়াড়, সংগঠক ছাড়াও কোচ, রেফারিরাও পেয়েছেন। সাকিব-তামিমদের গুরু নাজমুল আবেদীন ফাহিম জাতীয় স্বীকৃতি পেয়ে তৃপ্ত, ‘কাজের স্বীকৃতি পেলে আরো ভালো কিছু করার তাগিদ বাড়ে’। এক যুগের বেশি সময় ফিফা রেফারি তৈয়ব হাসান মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, ‘রেফারিং-আম্পায়ার থ্যাঙ্কলেস জব কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আমাদের মূল্যায়ন করায় ধন্যবাদ। জেড আলম স্যার সহ আমি দুই জন রেফারি রয়েছি এবার। আশা করি সামনে এই তালিকা আরো বাড়বে।’
৮৫ জন ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের মধ্যে সবচেয়ে তরুণ ভারত্তোলনের শাহরিয়া সুলতানা। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে এখন কোচিং করাচ্ছেন। এই কোচ জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রাপ্তির আনন্দে রাতেই ঘুমাতেই পারেননি, ‘আসলে গতকাল রাতে আমি ঘুমাতেই পারিনি। কখন সকাল হবে, কখন পুরস্কার পাব।’
শাহরিয়ার মতো ক্রীড়াঙ্গনের সবাই অপেক্ষায় থাকেন কখন হবে ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠান। সেই অপেক্ষা কখনো হয় ছয় বছরের আবার কখনো এর বেশি। বর্তমান যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী পরবর্তী ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের আর অপেক্ষামান রাখতে চান না, ‘২০২০ সাল পর্যন্ত পুরস্কার দেয়া হয়েছে। পরবর্তী বছরগুলোর পুরস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। আগামী বছর ২১-২২ সালের পুরস্কার প্রদান করতে পারব আশা করছি।’