চলমান ডলার সংকটের মধ্যেই ডলারের দাম বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। টাকার বিপরীতে এক লাফে ডলারের দাম ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এছাড়া চালুর ১০ মাসের মাথায় ব্যর্থ হয়ে ‘স্মার্ট সুদহার পদ্ধতি’ বাতিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে নীতি সুদহার দশমিক ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, হঠাৎ ডলারের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে। সুদহার বেড়ে গেলে ব্যবসায়ীরা দুর্দশায় পড়বে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। হু হু করে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। এর প্রভাব পড়বে নিত্যপণ্যের ওপর। জনগণের ঘাড়েই চেপে বসবে মূল্যস্ফীতির খড়গ।
বুধবার এক সার্কুলারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ‘ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রলিং পেগ বিনিময় পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ডলারের জন্য ক্রলিং পেগ মিড-রেট (সিপিএমআর) নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। এখন থেকে আন্তঃব্যাংক ও গ্রাহকের সঙ্গে লেনদেনে তফসিলি ব্যাংকগুলো সিপিএমআরের আশপাশে মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে।’
একই দিনে পৃথক সার্কুলারে নীতি সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘোষণায় বলা হয়েছে, নীতি সুদের করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা এবং নিম্নসীমাও বাড়ানো হয়েছে। নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) ক্ষেত্রে সুদহার ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশে এবং নীতি সুদহার করিডোরের নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অপর এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে ঋণের চাহিদা ও ঋণযোগ্য তহবিলের জোগান সাপেক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে।
‘ক্রলিং পেগ’ হচ্ছে দেশের স্থানীয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এটা অনেকটা নিয়ন্ত্রিত নীতিরই মতোই। এ নীতি হচ্ছে কোনো মুদ্রার বিনিময় হারকে নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে ওঠানামার অনুমতি দেওয়া। অর্থাৎ ডলারের বিনিময় হার ওঠানামার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমারেখা ঠিক করে দেওয়া। সাধারণত উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারজনিত অস্থিরতা তৈরি হলে এ সীমা সমন্বয় করা হয়। এটিকে দেখা হয় নিয়ন্ত্রিত বা বেঁধে দেওয়া বিনিময় হার থেকে উন্মুক্ত বাজারদরে প্রবেশ করার আগের ধাপ হিসেবে।
চলতি বছরের শুরু থেকেই ক্রমাগত ঋণের সুদহার বাড়ালেও এখনো দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। টানা গত ২২ মাস ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, সর্বশেষ মার্চেও দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।
অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরেই ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতা চলছে। এ সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া দরে বাজারে ডলার মিলছিল না। এ পরিস্থিতিতে প্রবাসী আয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছিল অবৈধ হুন্ডির বাজারে। আবার আমদানিকারকরা ঘোষিত দরের চেয়ে ১০-১৫ টাকা বেশি দিয়ে ডলার কিনতে বাধ্য হয়। এ পরিস্থিতিতে চলতি বছরের প্রথম দিকে এসে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে কীভাবে এ পদ্ধতি চালু হবে, সে বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এতে গেল মার্চের মধ্যে এ পদ্ধতি কার্যকরের কথা থাকলেও এর ঘোষণা আসতে চলতি মে মাস পর্যন্ত লেগে যায়।
ডলারের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর বুধবার বিকেলে খোলাবাজারে ১১৯ টাকায় উঠে যায়। যা সকালে যা ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোতে দর ছিল ১১৫ থেকে ১১৬ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ সিদ্ধান্তের বড় প্রভাব পড়বে সরকারের ব্যয়ে। কেননা, সার, বিদ্যুৎ, খাদ্যসহ বিভিন্ন আমদানির দায় মেটাতে সরকার ১১০ টাকায় ডলার পেত। এখন ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা দরে কিনতে হবে। এর ফলে ব্যয় অনেক বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের প্রভাবে দেশে বিরাজমান মূল্যস্ফীতি আরও উসকে উঠতে পারে। এতে নাজুক অবস্থায় যেতে পারে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘১১৭ টাকা যে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, ক্রলিং পেগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা গেলে ভালো। তবে এতে মূল্যস্ফীতি বাড়ার সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে।’
এদিকে ডলারের দাম বৃদ্ধি ও বাজারভিত্তিক সুদহারের প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘বাজারভিত্তিক করায় সুদহার বাড়ার সম্ভাবনা আছে। এতে বিনিয়োগ হবে কম। আর ডলারের দর বৃদ্ধি রপ্তানিকারক ও রেমিটারদের জন্য ভালো হলেও এতে আমদানিতে খরচ বাড়বে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংককে নজর রাখতে হবে আগের মতো আবার যেন ডলার ১২৪ থেকে ১২৫ টাকায় উঠে না যায়।’
নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমই-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এখন এমনিতেই সুদহার বেশি। এর মধ্যে বাজারভিত্তিক সুদহার হলে এটি আরও বেড়ে যাবে। সুদহার বাড়লে ব্যবসা স্থির হয়ে যাবে। কারণ, সবাই একটা হিসাব করে অর্থ নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। এখন যদি হিসাবের বাইরে বেশি সুদ দিতে হয়, তাহলে তার খরচ বেড়ে যাবে। বিরাজমান অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে উচ্চ সুদহার যোগ হলে ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে যাবে।’
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দেশ আমদানি নির্ভর। দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের অর্থনীতি চাপে আছে। এখন হঠাৎ করেই ডলার দাম খুব বেশি হলে এর নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে। বিশেষ করে আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাবে অনেক, এতে পণ্যের দামও বাড়াতে বাধ্য হবেন আমদানিকারকরা। হঠাৎ করেই ডলারের বেশি দাম বাড়ার এমন সিদ্ধান্তে চাপে পড়বেন সাধারণ মানুষ। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে, মানুষ কষ্ট পাবেন। তবুও আমাদের অর্থনীতিকে একটা জায়গাতে আনতে হবে। এক্ষেত্রে ধীরে ধীরে দাম বাড়লে হয়তো কষ্ট কিছুটা কম হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিৎ হবে সব দিক বিবেচনায় নেওয়া।’
২০২২ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, ‘শিগগির মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।’ একই বছরের ২২ আগস্ট ‘নবম বার্ষিক ব্যাংকিং কনফারেন্স’ উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অভ্যন্তরীণ সববরাহ বাড়িয়ে বৈশ্বিক এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগের ফলে মূল্যস্ফীতি আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। এছাড়া গত ১৭ জানুয়ারি মুদ্রানীতির অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, রোজার পরেই মূল্যম্ফীতি লক্ষ্যের কাছাকাছি আসবে। কিন্তু এসব আশ্বাসের কোনোটারই বাস্তব প্রতিফলন হয়নি।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রায় ১০ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ন্ত্রণ করতে লড়াই করছে। বিশ্বের সব দেশেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা পারিনি। আমাদের দেশের ঋণ খেলাপি, কর খেলাপি এবং অর্থপাচার একই সূত্রে গাথা। ঋণ পুনঃতফসিল করার কারণে ব্যাংকে অর্থের টান পড়েছে। এজন্য বন্ডের মাধ্যমে টাকা ছাপিয়ে অর্থ সরবরাহ করতে হচ্ছে। যার ফলে মূল্যস্ফীতি কমছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে মুক্তি পেতে এটি বন্ধ করা উচিত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের তদারকি পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে।’