ঢাকার আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আদালতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আইনজীবীরা মনে করছেন, খোদ ঢাকার আদালত চত্বর থেকে এভাবে পুলিশের ওপর হামলা করে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা সত্যি উদ্বেগজনক। জঙ্গি সম্পৃক্ত আসামিদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঢিলেঢালা ভাব দেখানোয় প্রশ্ন উঠেছে আদালতের বিচারক, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা নিয়েও। জঙ্গিরা আরও সশস্ত্রভাবে বড় ধরনের হামলা করলে বড় হতাহতের ঘটনাও ঘটতে পারতো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশের চোখে পিপার স্প্রে ছুড়ে পালিয়ে যাওয়া দুই আসামি হলেন- সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মাধবপুরের মইনুল হাসান শামীম ও লালমনিরহাটের আদিতমারি উপজেলার ভেটশ্বর গ্রামের আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব। মইনুল হাসান দীপন হত্যা মামলার এবং আবু সিদ্দিক সোহেল দীপন ও অভিজিত হত্যা উভয় মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অষ্টমতলায় সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হাজিরা শেষে ওই ভবনের নিচে ফটকে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। বাইরে থাকা সহযোগীরা আসামিদের নিতে যাওয়া পুলিশের চোখে পিপার স্প্রে ছুড়ে আসামিদের ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তারা আদালতের সামনে রাস্তা পার হয়ে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে অনেকে ঘটনা বুঝে উঠতে পারেননি বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেন, মোহাম্মদপুর থানার একটি মামলায় তাদের আদালতে হাজির করা হয়েছিল। যে মামলায় মোট আসামি ২০ জন। যার মধ্যে ৬ জন পলাতক, দুজন জামিনে ও ১২ জন জেলহাজতে ছিলেন। সেই ১২ জনকে জেলহাজত থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। জামিনে থাকা দুজনও আদালতে হাজির ছিলেন। জেলহাজতে থাকা ১২ আসামির মধ্যে চারজনকে একত্রে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ।
আসামিদের ডাণ্ডাবেড়ি না পরানোর বিষয়ে তিনি বলেন, আসামিদের হ্যান্ডকাফ পরানো ছিল। তাদের ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হয়নি। নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা ছিল তারাই ভালো বলতে পারবেন। জঙ্গি সম্পৃক্ত আসামিদের আদালতে হাজিরের ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত ছিল বলে মনে করেন ঢাকার মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, জঙ্গিরা যেভাবে এসেছে তাতে আরও বড় ধরনের নাশকতা হতে পারতো। বোমাবাজি বা সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটতে পারতো। সৌভাগ্যবশত তেমনটি হয়নি। এ ধরনের আসামিকে আদালতে হাজির করার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। আগেও তারা এসেছে আদালতে, তাই হয়তো গুরুত্ব পায়নি। তবে আগে হয়নি বলে কখনো হবে না, এমনটি ধারণা করা উচিত হয়নি।
দুর্ধর্ষ আসামির ক্ষেত্রে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর নিয়ম থাকলেও জঙ্গিদের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, সাধারণত যাদের জন্য প্রয়োজন কারাগার থেকে পাঠানোর তাদের ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে তেমনটি করা হয়নি। দুর্ধর্ষ ও জঙ্গি সম্পৃক্ত আসামিদের আদালতে আনলে অবশ্যই বিষয়টি ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রাখা উচিত ছিল।
এদিকে সারা দেশের অধস্তন আদালতে নিরাপত্তা জোরদারে নির্দেশনা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ফটক থেকে আসামি ছিনতাই এর ঘটনার পর তাৎক্ষণিক এই নির্দেশনা জারি করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র এবং আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশক্রমে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মৌখিকভাবে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেন আর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়।
এদিকে পুরান ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ফটক থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণে আসেন ডিবি পুলিশের প্রধান হারুন আর রশীদ। সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমরা শুনেছি আদালতের গেটে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের চোখে স্প্রে করে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়েছে অপর জঙ্গিরা। চার জন জঙ্গি মোটরসাইকেল করে আদালতে এসে দুই জনকে ছিনিয়ে নেয় পুলিশের চোখে স্প্রে মেরে। চোখে স্প্রে করার কারণে দায়িত্বরতরা কিছু দেখতে পারেনি।
ঘটনার পর দুপুরেই দুই জঙ্গিকে ধরিয়ে দিলে ১০ লাখ করে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এদিন দুপুরে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে এ কথা জানান তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, এ ঘটনাটি দুঃখজনক বলে আমরা মনে করি। যদি কারো অবহেলা থাকে, যদি কারো গাফিলতি থাকে, যদি কেউ ইচ্ছে করে এ কাজটি ঘটিয়ে থাকেন আমরা তার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। নিশ্চয়ই এটার তদন্ত কমিটি আমরা করবো এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।
তিনি আরও বলেন, ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আমরা রেড এলার্ট জারি করেছি। যাতে তারা দেশ থেকে পালিয়ে যেতে না পারে। আমাদের পুলিশ তাদের খুঁজছে। আশা করি শিগগিরই তাদের ধরতে পারবো। আমরা বর্ডার এলাকাগুলোতেও বলে দিয়েছি, তারা যেন পালিয়ে যেতে না পারে।
এ ঘটনায় ডিএমপির পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ডিএমপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক স্বাক্ষরিত অফিস অদেশে বলা হয়েছে, কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্)। এ ছাড়া কমিটির সদস্য করা হয়েছে ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (অপারেশনস্), ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি), ডিএমপির গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার ও ডিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (সিআরও)।
সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটের দিকে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক পুরান ঢাকার আদালত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি জানান, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ২০ জনকে আসামি করে কোতয়ালী থানায় মামলা হয়েছে। কোর্ট পরিদর্শক জুলহাস বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এছাড়া অজ্ঞাতনামা ৭/৮ জনকে মামলায় আসামি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত সাংবাদিকদের ডিএমপি কমিশনার বলেন, ওরা কয়েকজন জঙ্গি এসে পুলিশকে আক্রমণ করে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। এ সংক্রান্ত আমরা একটি মামলা করেছি। যারা পালিয়ে গেছে এবং যারা আটক আছে আটক তাদের বিরুদ্ধে একটা মামলা হয়েছে। আর আমরা একটা তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে এবং অন্যান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি কিছু থাকলে তা তদন্ত করে বের করার জন্য। আর ইতোমধ্যে আসামিদের গ্রেফতার করা ও তাদেরকে আইডেন্টিফাই করার জন্য আমাদের কাজ শুরু হয়ে গেছে। কারা আসছিল ছিনতাই করতে তাদের সংক্রান্ত আমরা বেশ ভালো তথ্য পেয়েছি। আশা করছি যারা ছিনতাই করে নিয়ে গেছে এবং যারা পালিয়ে গেছে তাদেরসহ গ্রেফতার করতে সক্ষম হব।